ব্লগ

সংগৃহীত

উজ্জীবিত তারুণ্য শক্তি, অনুপ্রাণিত নজরুল, এবং আমাদের ভবিষ্যৎ

অধ্যাপক ফেরদৌসী জাহান সিদ্দিকা

“নতুন পথের যাত্রা, পথিক হও আগুয়ান, উচ্চ কণ্ঠে উচ্চার আজ, মানুষ মহীয়ান।” স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও, আমাদের যুব সমাজ তাদের তারুণ্য শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ছাত্র-জনতার যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধন করেছে, তা আমাদের গর্বের বিষয়। এ অর্জন যেন বৃথা না যায়, বরং সাফল্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে—এই আশাবাদ বুকে ধারণ করি। ১৯৭১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যারা আত্মত্যাগ করেছেন, তাদের সকলের মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহতায়ালা তাদের সবাইকে শহিদী মর্যাদা দান করুন (আমিন)।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪

তারুণ্যের উদ্যমতায়, মৃত্যুকে উপেক্ষা করে বুক পেতে মৃত্যুকে বরণ, গুম, খুন, অত্যাচার এবং ভয়-ভীতিকে দূরে ঠেলে, আমাদের যুব সমাজ একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন শুরু করেছিল যা প্রথমে চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে উঠেছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তা সরকার পরিবর্তনের দিকে রূপ নেয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনুপ্রেরণামূলক চেতনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই আন্দোলনটি শুরুতে ছিল সুন্দর, সাবলীল, সুসজ্জিত এবং আশাপ্রদ। জাতীয় কবির গানে গানে আন্দোলনটি ছিল একত্রিতকারী এবং উদ্দীপ্ত; তার গান ছিল সেই ডাক যা বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে একত্রিত করেছিল। নজরুলের প্রভাব তখনকার যুবসমাজের মধ্যে যেমন গভীরভাবে অনুরণিত হয়েছিল, তেমনি আজও তরুণদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে। এই আন্দোলন প্রমাণ করেছে যে, নজরুলের বিদ্রোহ এবং প্রতিরোধের চেতনা এখনো বাংলাদেশে জীবিত এবং সুস্থ। যেখানে আন্দোলনের ফলাফল ভয়ানক ও জীবনবিনাশী হয়ে উঠেছিল, তা সবারই জানা। তবে আমার লেখার মূল বিষয় সেটা নয়; আমার লেখার মূল বিষয় হলো, দেশ গঠনে তারুণ্য শক্তির কাছে আমাদের প্রত্যাশা। সরকারি দুর্নীতি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ানো সাম্প্রতিক যুব আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্ররা প্রায়শই নজরুলের কবিতাকে অনুপ্রেরণা এবং সাহসের উৎস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জাতীয় কবির গানে গানে আন্দোলনটি ছিল সুন্দর, সাবলিল। নজরুলের গান এই আন্দোলনের জন্য একটি একত্রিতকারী ডাক হিসেবে কাজ করেছে, যেখানে তরুণরা ক্রমবর্ধমানভাবে পরিবর্তন চাইছে এবং স্থিতাবস্থা চ্যালেঞ্জ করছে, সেখানে নজরুলের উত্তরাধিকার বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। তার কবিতা বিপরীত পরিস্থিতিতেও সঠিকের পক্ষে দাঁড়ানোর গুরুত্বের একটি শক্তিশালী স্মারক।”বিদ্রোহী” কাব্যে নজরুলের “আমি করি না গোলাম, করি না দাস” বাণী আজকের তরুণদের মনে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তাঁর গান “আগুনের পরশমনি” যুবকদের মনে আগুন জ্বালিয়েছে এবং তাদেরকে অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অনুপ্রাণিত করেছে। সামাজিক মিডিয়ায় নজরুলের কবিতার ভাইরাল হওয়া এই আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

নজরুলের প্রভাব এবং আমাদের প্রত্যাশা

দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অস্থিমজ্জায় পচন ধরা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এই সংস্কারের জন্য নবীনদের বারবার এগিয়ে আসতে হবে এবং বয়োজ্যেষ্ঠ অভিজ্ঞজনদের জীবনভর অভিজ্ঞতাকে সহায়তা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। নবীনদের মনোযজ্ঞিক পরিবর্তন জরুরি, এবং নিজেদেরকে সংস্কারে আনতে হবে। জাতীয় কবির অমর সৃষ্টির প্রভাবে, আমাদের আশা হচ্ছে— আমরা ঝঙ্কার মত উদ্যমী, ঝরনার মত চঞ্চল, এবং প্রকৃতির মত স্বচ্ছল হতে পারব।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যুগের যন্ত্রণাকে ধারণ করে আমাদের চেতনায় প্রজ্জ্বলিত করেছেন। তাঁর কবিতা ও গান আমাদের শক্তি ও অনুপ্রেরণার উৎস, যা আজও তরুণদের শক্তি ও উদ্যমে প্রভাবিত করছে। নজরুলের বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের চেতনা বাংলাদেশের সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকারের বার্তা নিয়ে বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে লড়াই করতে অনুপ্রাণিত করেছে। আজকের বিশ্বে, যেখানে তরুণরা পরিবর্তন চাইছে এবং স্থিতাবস্থা চ্যালেঞ্জ করছে, নজরুলের উত্তরাধিকার বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। যেভাবে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী হিন্দু-মুসলিম বিভাজনকে জিইয়ে রেখে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে চেয়েছিল, তেমনিভাবে আজও কিছু শক্তি এই বিভাজনকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কলম সেচ্ছার হায় উঠেছিল “মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান”। তাঁর কলমের দীপ্তি ছিল অসাম্প্রদায়িকতা এবং ঐক্যের ডাক। তাঁর এই চিন্তা আমাদের জাতীয় চেতনার অঙ্গ, যা লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের স্বার্থে বজায় রাখতে হবে।

মাননীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু বলে কিছু নেই, আমরা সবাই বাংলাদেশি।” তাঁর পরও, অপচেষ্টা এবং বিভাজনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ বৃথা হতে দেওয়া যাবে না। নিজেদেরকে জানার তাগিদেই নজরুলকে চর্চায় আনতে হবে। কবি নবীনদের নব নব সম্ভাবনার অগ্রদূত হিসেবে উত্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, তরুণ শক্তি হচ্ছে বিপুল গতিবেগের ঝঞ্চার মত, যার আশা ও প্রাণ অতল। সাম্প্রতিক সময়ে মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করে, তরুণ শক্তি যেন দণ্ডায়মান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

একজন শিক্ষক হিসেবে এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার আওতায়, আমি মনে করি— জাতীয় কবির গান ও আদর্শের সৈনিক হয়ে বৈষম্যহীন ছাত্র আন্দোলনের ফলাফল ধরে রাখতে হবে। ন্যায় প্রতিষ্ঠা, সত্যকে সত্য বলা, এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলা— এ সাহসে উজ্জীবিত হতে হবে। নির্লোভ মানসিকতা এবং দৃঢ় প্রত্যায়ে আমরা প্রকৃতির মত স্বচ্ছল হয়ে উঠব। নবীনদের কাছে আমার প্রত্যাশা, দেশের সকল ক্ষেত্রে সংস্কার করে জ্ঞানভিত্তিক, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন করা এবং মানবতাবাদী কবির প্রাণশক্তি সঞ্চারিত করা।

ভাঙো ভাঙো এই ক্ষুদ্র জ্ঞান এবং অজ্ঞতা। মহামানবের মত যারা জাগ্রত, তাদের জাগিয়ে তোলার প্রয়াসে কবির ৪৮তম মৃত্যুবাষির্কীতে আত্মার শান্তি কামনা করি।

লেখক: ফেরদৌসি জাহান সিদ্দিকা, সহকারী অধ্যাপক, তুলসীঘাট শামসুল হক ডিগ্রি কলেজ
প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক, নজরুলচর্চা কেন্দ্র, বাদিয়াখালি, গাইবান্ধা

নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকেকি শিক্ষা নিই

কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। ১৮৯৯ সালের ২৫ মে বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে দুঃখ-দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। এ জন্য তাঁর ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। কবির বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মা জাহেদা খাতুন। এ বছর কবির ১২২তম জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপিত হচ্ছে। জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

প্রেম, দ্রোহ, সাম্য ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণপুরুষ। তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁর লেখনী গোটা ভারতবর্ষের মানুষকে প্রেরণা জুগিয়েছিল। সে পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বিদ্রোহী চেতনা ফুটে ওঠে, তিনি পরিণত হন বিদ্রোহী কবিতে। সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, অত্যাচার, নিপীড়ন, অনাচার, বৈষম্য, শোষণ, নির্যাতন ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে আপসহীন সাহসী কণ্ঠে সোচ্চার হয়ে কবি লিখে গেছেন অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, সংগীত, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও অন্যান্য লেখা। আর সে কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর গ্রন্থ ও রচনা বাজেয়াপ্ত করেছে এবং তাঁকে কারাদণ্ডও দিয়েছে। কারাগারেও বিদ্রোহী নজরুল বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। টানা ৪০ দিন অনশন করে ব্রিটিশ সরকারের অন্যায়-অত্যাচার জেল-জুলুমের প্রতিবাদ করেছিলেন। কবি নজরুল একটি শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক সমাজ গড়ার জন্য লড়াই করে গেছেন। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি পূর্ণাঙ্গভাবে ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন।

তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের শোষণ, নির্যাতন, অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে মাত্র ২০ বছর বয়সী এক তরুণের হৃদয়ে যে বিদ্রোহ, শোষণ, বঞ্চনা, পরাধীনতা, গ্লানি, ক্ষোভ, দ্রোহ জেগে উঠেছিল তারই বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়, যা তখনকার ক্ষুব্ধ প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে প্রজ্বলিত মশাল হিসেবে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল। তিনি প্রতিবাদী কণ্ঠ নিয়ে আবির্ভূত হয়ে বলেছিলেন—‘বল বীর, বল উন্নত মম শির’ অথবা ‘মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়্‌গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না’। যা পরবর্তীকালে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে অন্যতম প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়।
নজরুলকে নিয়ে গবেষণা করে দেখা যায়, নজরুল ছিলেন একজন ইতিহাস ও সময়সচেতন লেখক। যার স্পষ্ট প্রভাব তাঁর লেখায় পাওয়া যায়। তুরস্কে কামাল পাশার নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আর ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের চিত্রকে নজরুল তাঁর সাহিত্যে মহাসমারোহে ধারণ করেছেন।

পাগলকে দিয়ে গান গাইয়ে কবি নজরুল বললেন, হুজুগে বাংলায় এসব একবারই চলে……….

কবি নজরুল তখন খুব ব্যস্ত। নিয়মিত গ্রামোফোন কোম্পানীর রিহার্সাল রুমে আসেন, গান লিখেন, সুর করেন, গান শিখিয়ে দেন। বেশীর ভাগ গান গাইছেন কে মল্লিক। একদিন এই কে মল্লিকের কাছে এক লোক এল। লোকটির নাম প্রফেসর জি দাস। এসে ধরল মল্লিক কে-
দেখুন মল্লিক বাবু, আপনার বাড়ী কালনা, আমার বাড়ী কাটোয়া, বলা চলে একই দেশের লোক। আমাকে কি আপনি একটু উঠতে দিবেন?
আরে, দেশের লোক উঠতে পারলে তো আমারই খুশী। তো কী চান বলুন।
আমি গান গাইতে চাই, নেবেন আমাকে?
কিন্তু গান গাইতে হলে তো পরীক্ষা দিতে হবে আমাদের কোম্পানীতে।
জ্বী আমি রাজী।
পরীক্ষা নেয়া হল প্রফেসরের। ফলাফল একেবারে অচল। গান নেওয়া হবে না শুনে ওখানেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলেন বেচারা প্রফেসর। কে মল্লিক যতই সান্তনা দেন, বেচারা ততই দ্বিগুণ কাঁেদন। আওয়াজ শুনে এলেন কোম্পানীর বড়বাবু। তিনি সব শুনে প্রফেসরকে বললেন, আপনার গলা এখনও ঠিক হয়নি। সুর তাল লয় ঠিক থাকছেনা, কদিন পর আসুন, দেখা যাক কী হয়।
প্রফেসর লোকটি তখন বড়বাবুর কাছে কয়েকজনের নামে বিচার দিলেন যারা তাকে ফুঁসলিয়ে মিষ্টি খেয়ে নিয়েছে তার কাছ থেকে। ওরা নাকি তাকে এও বলেছে যে তোমার গলা ভাল হলেও কে মল্লিক হিংসা করে তোমাকে গান গাইতে দিবে না। বড়বাবু বুঝলেন যে বেচারা খুব সরল মানুষ, তাকে যেভাবে বুঝানো হয়েছে সে বুঝেছে। প্রফেসরের কান্না আর থামছে না।
এমন সময় রুমে ঢুকলেন কাজী নজরুল। কী ব্যাপার? বলে তিনি মনোযোগী হলেন কান্নাকাটির কারণ জানতে। বড়বাবু আর কে মল্লিক তাকে সব খুলে বললেন। কবি তখন বললেন, বেচারা থেকে রেকর্ডের আশ্বাস দিয়ে যখন মিষ্টি খাওয়া হয়েছে, অতএব তার একটা গান রেকর্ড করতেই হবে।
আরে কাজীদা, কী বলছেন আপনি? দেখছেন না লোকটা একজন পাগল।
আরে মল্লিক, আমারা বাঙালীরাও কিন্তু কম হুজুগে নই, দেশটাও হুজুগে। এই বলে কবি প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললেন, শোনো, তুমি কাল এস, তোমাকে শিখিয়ে আমি রেকর্ড করিয়ে নিব।
কবি নজরুল বলে কথা। মল্লিক আর বড়বাবু তাকে ভাল করেই জানেন। কাজেই সবাই পরবর্তী কান্ড তামাশা দেখার অপেক্ষায় থাকলেন।
পরদিন কবি এসে দেখেন, প্রফেসর জি দাস অনেক আগেই এসে হাজির। কবি তাকে দেথে বললেন, যাও মল্লিককে ডেকে আনো।
আবার মল্লিকের নাম শুনে মন খারাপ হয়ে এল বেচারার। কাজীদা, ঐ লোকটি এলে আমার গান খারাপ করে দেব’ বলে অভিযোগ করলেন মল্লিকের বিরুদ্ধে।
কবি তাকে সন্তনা দিয়ে বললেন, আরে না, মল্লিক খুব ভালো লোক, তোমার সাথে কেমন সুন্দর হারমোনিয়াম বাজায়, তুমি দেখো।

খবর পেয়ে মল্লিক সাহেব এলেন। কাজী নজরুল তাকে দেখে বললেন, আরে আসুন আসুন, প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তবলাওয়ালাকে ডাকো, তারপর দরজায় খিল এঁটে দাও।
রিহার্সাল রুমে তখন চারজন। কাজী নজরুলের কান্ড দেখার জন্য মল্লিক সাহেব চোখ বড় করে তাকিয়ে আছেন। তবলাওয়ালাও ভাবছে, এই পাগলকে দিয়ে কী গাওয়াবেন কাজী সাহেব, কে জানে?
কবি এবার তৈরী হয়ে প্রফেসরকে বললেন, শোনো, তোমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, কী গাইবে, কিছুই বলবেনা তখন। খুব সাবধান, বাজারে রেকর্ড এলে যেন সবাই শুনে। তার আগে যেন কেউ টের না পায়।
বেচারা প্রফেসর মাথা নেড়ে সুবোধ বালকের মত সায় দিল। হেসে হেসে বলল, না , না, কাউকে শোনাবো না।
আচ্ছা, এবার গান ধরো, বলে কাজী নজরুল তাকে বলতে বললেন,
কলা গাড়ি যায় ভষড় ভষড়/ ছ্যাকরা গাড়ী যায় খচাং খচ/ ই্িচং বিচিং জামাই চিচিং/ কুলকুচি দেয় করে ফচ।।
অদ্ভুত এমন গান শুনে উপস্থিত বাকী দুজন ওখানেই হাসতে লাগলেন, কবির কান্ড দেখে তারা ততক্ষণে খেই হারিয়ে ফেলছেন। পরের দিন এর আরেকা জোড়া লিখে আনলেন কবি, এবার অপর পিঠে রেকর্ড করালেন আরেক গান-
মরি হায় হায় হায়. কুব্জার কী রুপের বাহার দেখো।/ তারে চিৎ করলে হয় যে ডোঙা/ উপুড় করলে হয় সাঁকো।/ হরি ঘোষের চার নম্বর খুঁেটা, মরি হায় হায় হায়//
এ গানে প্রফেসরকে যে চতুষ্পদ বানানো হচ্ছে, তাও কেউ টের পেলনা। খুব উৎসাহে প্রফেসর রিহার্সাল করতে থাকল। রেকর্ডিং ম্যানেজারকেও জানানো হলনা, কী গান কাকে দিয়ে রেকর্ড হচ্ছে? চরম গোপনে গান দুটো রেকর্ড হল, তারপর বাজারে ছাড়া হল।
বাজারে প্রকাশিত হওয়ার দু একদিন পর কবি মল্লিককে ডেকে বললেন, একটু দেখে আসুন তো বাজার থেকে, কেমন বিক্রি হচ্ছে গান দুটো?
বাজারে খোঁজ নিয়ে এসে মল্লিক হাসতে হাসতে বললেন কবিকে, কাজী দা, খুব বিক্রি হচ্ছে অদ্ভুত গানদুটো। ক্রেতারা কিনছে আর গাইছে, কলা গাড়ী যায় ভষড় ভষড়…..

কোম্পনীর ম্যানেজার তো দারুণ খুশী। বড়বাবুকে ডেকে বললেন, তুমি তো বলেছিলে, লোকটি পাগল। ওর গান তো বেশ সেল হচ্ছে, আরো দু একটা নাও না ওর গলায়..

মল্লিক সাহেব দৌড়ে গিয়ে কাজীকে কর্তার প্রস্তাব জানালেন। কবি হাসতে হাসতে বললেন, মল্লিক সাহেব, এবার কিন্তু গালাগাল খেতে হবে, হুজুগে দেশে এসব একবারই চলে। বলেই আবার জোরে হাসিতে ফেটে পড়লেন আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

এই ছিল তার রসিক কান্ড, খেয়াল খুশীতে তিনি পাগলকে দিয়েও বাজার মাত করে ফেললেন, অবাক হয়ে পুরো কোম্পানী তার প্রতিভার কাছে তাই মাথা নুইয়ে থাকতো।


নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে ছিলেন কবি নজরুল, কিন্তু জয়ী হয়ে ছিলেন ?

কাজী নজরুল ইসলামের জীবনকাহিনী যতই পড়ি ততই বিমুগ্ধ হতে হয়। নির্বাক হওয়ার আগে তিনি যে কবছর তার কর্ম ও সৃষ্টিতে তৎকালের সবাইকে হতবাক করে যাচ্ছিলেন, তার সেসময়গুলো ছিল বড্ড বিচিত্র।

ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন বন্ধনহীন। কোন বাধা তাকে আটকাতে পারেনি। যখন যা চেয়েছেন, আপনমনের খেয়ালে তা-ই করেছেন। ঠিক কি বেঠিক, ভাল কি মন্দ- সব তিনি করেছেন পরমানন্দে।

অনেকের হয়তো জানা নেই যে, আমাদের প্রিয়কবি নজরুল কিন্তু নির্বাচনেও দাঁড়িয়েছিলেন। অবাক হলেও কিছু করার নেই, কারণ তিনি ঐ নির্বাচনে জয়লাভ করেননি।

১৯২৬ সাল। মাসের নাম নভেম্বর। পূর্ববঙ্গের নির্বাচনে কবি নজরুল কেন্দ্রীয় আইনসভার সভ্যপদপ্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দিতায় নেমেছিলেন। শুধু কি তাই, এ নির্বাচনী প্রচারের জন্য তিনি এসেছিলেন ঢাকা, ফরিদপুরসহ কয়েক জায়গায়।

কবির আশা ছিল, তার এ নির্বাচনে কংগ্রেস তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু কবি নজরুল তা পাননি। ফলে হয়ত তিনি নিশ্চিত ছিলেন পরাজয়ের ব্যাপারে। কাজেই ২৯ নভেম্বর ফলাফল প্রকাশের তারিখ হলেও তিনি ২৩ নভেম্বর ফিরে আসেন।

ব্রজবিহারী বর্মণকে লেখা এক চিঠিতে কবি তার এ পরাজয়ের জন্য কংগ্রেসের তরফ থেকে যথেষ্ট সাহায্য না পাওয়াকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ছোটবেলা থেকেই চাল চলনে ও আচার ব্যবহারে কাজী নজরুলের ঔদাসীন্য দেখে তার গ্রামের লোকজন তাকে ডাকত ‘তারা খ্যাপা’ বলে। কেউ কেউ এতিম নজরুলকে দেখে আদর করে ডাকত ‘নজর আলী’ বলে।

দারিদ্য ছিল তার পরিবারের নিত্যসঙ্গী। আয় রোজগারের জন্যই তিনি তার বাবার মৃত্যুর পর অল্প বয়সেই মসজিদের দায়িত্ব পালন করতেন আজান দিয়ে, নামাজ পড়াতেন ইমামতি করে।

সংসারের ভরণপোষণ আর সেইসাথে তার ভেতর যে প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটছিল তার তাগিদে মাত্র বার তের বছর বয়সী নজরুল ফাঁকে ফাঁকে গান গজল কবিতা লিখতেন।

একটু নাম ডাক ছড়িয়ে যাওয়ায় এ বয়সেই তিনি তিনটি লেটোনাচের দল, যা ছিল তৎকালে পশ্চিমবঙ্গের আমোদ বিনোদনের মাধ্যম, নিমসা, চুরুলিয়া এবং রাখাখুড়া- এ তিনটি দলের নাটক রচনার ভার পেয়েছিলেন।

এসব আয়োজনে কবির লড়াই নামে একটি অংশ থাকত। এতে তখনকার কবিরা নিজেদের কবিতা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামতেন। যে কবি জিততো তাকে গোদাকবি আখ্যায়িত করা হতো। নজরুলের ছোটবেলায় তাদের গ্রামে যে গোদাকবি থাকতেন, তিনি নজরুলকে ডাকতেন আদর করে ‘ব্যাঙাচি’ বলে। প্রায়ই তিনি বলতেন, তোমরা দেখে রাখো, আমার এ ব্যাঙাচি একদিন বড় হয়ে সাপ হবে।’ গোদাকবির সে ধারণা যে মোটেও মিথ্যা ছিলনা, তার প্রমাণ এই এত বছর পরও আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

গুরু-শিষ্য বন্দনা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম

বাংলা সাহিত্যে দুই হীরকরত্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। দু’জনই স্বীয় প্রতিভায় প্রতিষ্ঠিত এবং মৌলিক ও যুগপ্রবর্তক সাহিত্যিক। তাঁরা দু’জন শুধু বাঙালীর কাছে নন সমগ্র বিশ্বে সমানভাবে শ্রদ্ধেয়। বাংলা সাহিত্য ভান্ডারে তাদের রেখে যাওয়া সম্পদ শুধু বাংলা সাহিত্যকে পরিপূর্ণই করেনি, করেছে বিশ্বদরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত। রবীন্দ্রনাথের লেখায়আমরা যে রেনেসাঁ প্রত্যক্ষ করেছি, তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পেরেছেন একমাত্র কাজী নজরুল ইসলাম।

রবি ঠাকুরের লেখনিতে ফুটে উঠেছিলো সর্বজনীন প্রেমানুভূতি এবং প্রেমের মাহত্ব্য । তিনি এই অনুভূতিকে কখনোই নির্মম হতে দেননি। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শুরু করে ভালোবাসায় তিনি গেয়েছিলেন প্রেমের জয়গান । অপরপক্ষে ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থার প্রতি তীব্র ক্ষোভ লক্ষ্য করা যায় কবি কাজী নজরুলের সাহিত্যকর্মে। তিনি সবকিছু ভেঙ্গেচুরে নতুন করে গড়ে তোলার পক্ষে ছিলেন সরব। আর তাইতো তিনি বিদ্রোহী কবি। যে প্রেম দিয়ে সমাজ গড়ার ব্যর্থ প্রয়াস করেছিলেন কবিগুরু , বিদ্রোহে, জ্বালাময়ী বক্তব্যে সেই কাজটিই করেছিলেন কবিগুরুর প্রিয়পাত্র নজরুল। তাইতো জ্বলন্ত নজরুলের আবির্ভাবে নতুন সূর্য দেখেছিলেন তিনি। বুকে টেনে নিয়ে অভিবাদন জানাতে ভুল করেন নি।

কেমন ছিলো এই দুই অসম বন্ধুর সম্পর্ক। হ্যাঁ কবিগুরুকে গুরু বলেই মেনেছিলেন নজরুল ইসলাম। আবার তরুণ নজরুলের প্রতি কবিগুরুর ছিলো অসীম স্নেহ আর ভালোবাসা। তেমন কিছু ঘটনার আলোকপাত করা হবে এই প্রবন্ধে।

শৈশবে দারিদ্রতায় জর্জরিত নজরুলের ছিলো সাহিত্যের প্রতি বিশেষ টান। তার প্রথম শিক্ষাগুরু চাচা কাজী বজলে করিমের নিকট ফার্সি ও উর্দু ভাষা শিক্ষকে থাকেন। কাজীনজরুল বাল্য কালেই পরিস্থিতির প্রভাবে অনেটকা বাউণ্ডুলে স্বভাবের হয়ে উঠেন।তিনি বিভিন্ন সময়ে পীর ফকির, সন্যাসী, বৈষ্ণব বাউল, সুফী দরবেশের আস্তানায়যেমন যেতেন ,তেমনী আশপাশের হিন্দু পরিবারে ভাগবাত, রামায়ন, মহাভারত পাঠেরআসারে ও যোগ দিতেন। আবার কখনও সাধু সন্তু, পীর ফকিরের সাথে উধাও হয়ে যেতেন, আবার ফিরে আসতেন। তাঁর এরূপ খাম-খেয়ালী উদাসীনতায় কেউ কেউ তাঁকে কখনও “নজরআলী” কখন ও বা “তারা ক্ষ্যাপা” বলে ডাকতেন । উনবিংশ (বিংশ) শতাব্দীতেবাংলার গ্রামগঞ্জে কবি-কীর্ত্তন, বাউল, সারি গানের হাওয়ায় পল্লীতে প্রকৃতি মুখরিত হয়ে উঠত।

নজরুলের গ্রামেই ছিল শেখ বাক্র আলী গোদার কবিগানের দল, তিনি সে দল ভিড়ে গেলেন। অল্পদিনেই কবি দলের গোদা শেখ বক্র ক্ষুদেকবির কবিত্বে মুগ্ধ হয়ে বলে ছিলেন, “এই ব্যাঁঙাচি বড় হয়ে সাপ হবে” হয়েছিলেন ও তাই। অল্পদিনের মধ্যেই নজরুল সে দলের সেরা কবিয়াল হিসেবে সকলকে মুগ্ধ করেছিলেন।

অল্পদিনের মধ্যেই নজরুল সে দলের সেরা কবিয়াল হিসেবে সকলকে মুগ্ধ করেছিলেন। এই লেটোকবির দলে থেকে সেই বাল্যকালে তিনি “রাজপুত্র” ‘চাষার সং,কবি কালিদাস, শকুনি বধ’ প্রভৃতি পালা রচনা করেন।যেমনঃ ‘অসংখ্য গ্রাম নগরাদি/দূর্গ গুহা পর্বত আদি কত নদনদী/ দেখিলাম কিন্তুনিরবধি/ স্বদেশ জাগিছে অন্তরে” (রাজপুত্র)।

শৈশব থেকেই নজরুল রবীন্দ্রনাথকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন । শৈশবে দরিরামপুর স্কুলে একটি বিচিত্রানুষ্ঠান হয়, সে অনুষ্ঠানে নজরুল রবীন্দ্রনাথের ‘পুরাতনভৃত্য’, ও ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতা দুটো আবৃত্তি করে উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধকরে দেন। নজরুল তাঁর ‘বড়র পিরীতি’ ‘বালির বাঁধ’ প্রবন্ধে বলেছেন, ছেলেবেলা থেকে তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) ছবি সামনে রেখে গন্ধধূপফুলচন্দন দিয়েসকালসন্ধ্যা বন্দনা করেছি।’ এ উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় নজরুল রবীন্দ্রনাথকেকতোটা শ্রদ্ধা করতেন। পরবর্তীকালে করাচিতে সৈনিক জীবনেও রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি নজরুলের কাছে থাকত। সৈনিক জীবন শেষে কলকাতায় এসেও প্রথমে নজরুল গাইতেন রবীন্দ্রনাথের গান। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আগে ও পরে নজরুল কয়েকটি কবিতা ও গান রচনা করেছেন। সেগুলো অত্যন্ত সুন্দর।

১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের পরে নজরুলের সাংবাদিক সাহিত্যিক জীবনের শুরুতে কলকাতার সাহিত্যিকদের দু’টি বিখ্যাত আড্ডা ছিল। একটি ‘ভারতী’রকার্যালয়ে তথা সুকিয়া স্ট্রীটে (বর্তমান কৈলাস বসু স্ট্রীট) ছিল ‘‘ভারতী’-রআড্ডা’’, অন্যটি ‘গজেন্দ্র চন্দ্র ঘোষের ৩৮ নং কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটের বাড়ির ‘সাহিত্যের আসর’, যাকে বলা হত ‘‘গজেন-দা’র আড্ডা’’ সেখানে অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়সহ অনেকেই যেতেন। সেখানেইএকদিন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তে-র সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়। প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, (কবি নজরুল পৃষ্ঠা-১২৬) নজরুল সেই আড্ডায় এসে রবীন্দ্র-সংগীত শোনাতেন।

নজরুল ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পরিচিত হওয়ার কাহিনী পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় বর্ণনা করেছেন তাঁর ‘চলমান জীবন’ দ্বিতীয় পর্বগ্রন্থে। সেখানে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নজরুলকে জড়িয়ে ধরে বলেন,

‘তুমি ভাই, নতুন ঢেউ এনেছ। আমরা তো নগন্য, গুরুদেবকে পর্যন্ত বিস্মিত করেছ তুমি।’

বিহবল হয়ে প্রশ্ন করে কাজী,

‘গুরুদেব আমার কোনো লেখা পড়েছেন নাকি?সত্যি বলতেন কি?’

বললেন সত্যেন দা,‘গুরুদেবই আমাকে একদিন নিজ থেকে প্রশ্ন করলেন, কাজী নজরুল ইসলামের কোনো কবিতা পড়েছি কি না।’ তাঁর মতে, ‘ভাবের সংস্কৃতিসমন্বয়ের সাধনার এই এক নতুন অবদান আনছ তুমি।

আনন্দেরআতিশয্যে মুখের কথা শেষ করতে পারে না নজরুল,‘গুরুদেব বলেছেন!’ 

গুরুশিষ্যের প্রথম দেখা হওয়ার ইতিহাসঃ

পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় বর্ণিত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কথিত রবীন্দ্রনাথেরউক্তিতে বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথযথার্থই বুঝতে পেরেছিলেন, নজরুলের লেখাভাবেরসংস্কৃতি সমন্বয়ের সাধনায় এএক নতুন অবদান। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঠিক কততারিখে নজরুলের দেখা হয়, তা জানাযায় নি।‘ তবে প্রভাতকুমারের ‘রবীন্দ্রজীবনী’ পৃষ্ঠা-৮৬ থেকে জানা যায়, ১৯২০খ্রিস্টাব্দের ১২ মে থেকে১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাস পর্যন্ত প্রায়চৌদ্দ মাস রবীন্দ্রনাথ ইউরোপে ছিলেন। ইউরোপ থেকে ফিরে পুনরায় ১৯২১খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই পর্যন্ত ইউরোপআমেরিকা সফর করেন। ১৬ জুলাই বোম্বাইথেকে বর্ধমান হয়ে বোলপুর আসেন। ২০ জুলাই ১৯২১ কলকাতা আসেনআত্মীয়স্বজনবন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য। মাঝখানে একবারশান্তিনিকেতনে ফিরে গেলেও সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখপর্যন্ত তিনি কলকাতায় ছিলেন।ওই সময়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের প্রথম দেখা হয়েছিলো সম্ভবত।

আবদুল আজিজ আল্-আমানের লেখা বইয়ে (নজরুল-পরিক্রমা’, ২২-২৪ পৃষ্ঠা) পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে গিয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাতের কথা জানা যায়। নজরুল করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে আসার পর ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি সুধীসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হলেও রবীন্দ্র-দর্শন তখন পর্যন্ত হয়নি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করবার জন্য নজরুল তখন আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। অবশেষে সুযোগ মিলেছিল। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমেই দুই কবির মধ্যে প্রথম পরিচয় হয়। একদিন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় গেলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। প্রয়োজনীয় কথার পর রবীন্দ্রনাথের সম্মুখে ‘মোসলেম ভারত’ দেখে পত্রিকাটি সম্পর্কে কথা তুললেন পবিত্র বাবু। সে সময় ‘‘মোসলেম ভারত’ মানেই নজরুল। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে নজরুলের কথা জিজ্ঞেস করলেন এবং বিশেষ আগ্রহের সঙ্গে তাঁকে নিয়ে আসার আহবান জানালেন।শেষে নির্দিষ্ট দিনে পবিত্র বাবু নজরুলকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সামনে হাজির হলেন। সেদিন তাঁদের মাঝে বিশেষ কোনো কথা হয়নি।

তাছাড়া, সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমাদের নজরুল’ প্রবন্ধের বর্ণনা থেকে মনে হয় কলকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের প্রথম সাক্ষাৎ হয়।

জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসার সময়তেমন বড়লোককেও সমীহ করে যেতে দেখেছি, অতি বাকপটুকেও ঢোঁক গিলে কথা বলতেশুনেছি কিন্তু নজরুলের প্রথম ঠাকুর বাড়িতে আবির্ভাব সে যেন ঝড়ের মত। অনেকেবলত, তোর এসব দাপাদাপি চলবে না জোড়াসাঁকোর বাড়িতে, সাহসই হবে না তোরএমনিভাবে কথা কইতে। নজরুল প্রমাণ করে দিল যে, সে তা পারে। তাই একদিন সকালবেলা ‘‘দেগরুর গা ধুইয়ে,-এই রব তুলতে সে কবির ঘরে গিয়ে উঠল কিন্তু তাকেজানতেন বলে কবিঅসন্তুষ্ট হলেন না।’’

শান্তি নিকেতনে বিশ্বকবি

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের ইতঃপূর্বে সাক্ষাৎ হয়নি। ছোটবেলা থেকে তিনি যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন, তাতে সাবিত্রী প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় যেভাবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাতের কথা বলেছেন-তাও অদ্ভুত বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের কথা লিখতে গিয়ে তিনি বাড়িয়ে লিখছেন কি না সে প্রশ্ন এসে যায়। কারণ যাঁর সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি, তাঁর সঙ্গে নজরুল দেখা করতে গেলেও ওভাবে রব তুলতে তুলতে গেছেন বলে মনে হয় না।

জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্র-নজরুলের সাক্ষাতের ব্যাপারে একটি তথ্য পাওয়া গেলেও প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের কোন সময়ে, কোন স্থানে সাক্ষাৎ ঘটেছিল তার কোনো তথ্যভিত্তিক প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে নজরুলের সৃষ্টিক্ষমতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ জানতেন। তাঁর চিন্তাধারা ও কর্মজগৎ সম্পর্কেও তিনি খবর রাখতেন। শান্তিনিকেতনে নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনে ছিলেন সুধাকান্ত রায় চৌধুরী। তিনি রবীন্দ্রনাথের একান্তসচিব ছিলেন। নিজেও কবিতা লিখতেন এবং নজরুলের কবিতা পত্র-পত্রিকা থেকে রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনাতেন।

প্রভাতকুমারের ‘রবীন্দ্রজীবনী’ তৃতীয় খন্ড পৃষ্ঠা-১২০ থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাতের ব্যাপারে একটি তথ্য পাওয়া যায়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের শরৎকালে পূজোর ছুটিতে নজরুলকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্। সেবার দুর্গাপূজা ছিল ৮ই অক্টোবর। কলকাতায় গান্ধীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শান্তিনিকেতনে ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ৮সেপ্টেম্বর থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। তিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রান্তর মধ্যস্থিত পর্ণকুটিরে। অনেকেই তখন তাঁর সাথে দেখাকরতে আসেন। তরুণ কবি নজরুলও তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন।

শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎকারের স্মৃতিচারণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের তখনকার একান্ত সচিব কবি সুধাকান্ত রায়চৌধুরী’র ভাই নিশিকান্ত রায়চৌধুরী ‘আমার কৈশোর স্মৃতিতে নজরুল’ প্রবন্ধে। নিশিকান্ত রায় তখন শান্তিনিকেতনের বালক-ছাত্র। পূজোর ছুটি শেষ হয়ে গেছে। শান্তিনিকেতনের আশ্রমে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষয়ত্রীরা সবাই এসে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথও বাইরের থেকে ঘুরেএসেছেন। নিশিকান্ত সবে শিশুবিভাগ থেকে নুতন গুরুপল্লীতে দাদা সুধাকান্তের বাড়িতে এসেছেন। এমন সময় নিশিকান্তের দাদা সুধাকান্ত তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের বলছিলেন যে, হাবিলদার কবি কাজী নজরুল ইসলাম সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেদেখা করতে আসবেন। নিশিকান্তের ভাই সুধাকান্তের ওপরই ভার পড়েছিল স্টেশন থেকে নজরুলকে নিয়ে আসবার। কলাভবনের দোতলায় সান্ধ্য আসরে সুধাকান্তের সঙ্গে সচকিত মন নিয়ে নিশিকান্তও সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। সবার মাঝখানে রবীন্দ্রনাথ বসেছিলেন।

শিক্ষক-শিক্ষয়েত্রীবৃন্দ সবাই উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পাশে বসা দু’জন আগন্তুকের একজনের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে সুধাকান্ত নিশিকান্তকে বললেন, ‘ঐ দেখ কবি নজরুল ইসলাম।’ সুধাকান্ত নিশিকান্তকে নজরুলকে দেখিয়ে দিলেন। এবং পরে তিনি নজরুলের পাশে গিয়ে বসলেন। নজরুলের পাশেই ফেজ-পরা কাঁচা-পাকা দাড়ি নিয়ে একজন বসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মাঝে মাঝে আলাপ করছিলেন। নজরুলও সেই আলাপে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ডক্টরমুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্। শহীদুল্লাহ সাহেব তখন রবীন্দ্রনাথকে বলছিলেন, ‘ট্রেনে আসতে আসতে কাজী সাহেব আপনার ‘গীতাঞ্জলি’র সবক’টা গান আমাকে গেয়ে গেয়ে শুনিয়েছেন।’ রবীন্দ্রনাথ তখন বলেছিলেন, ‘তাই নাকি? অদ্ভুত স্মৃতিশক্তিতো! গীতাঞ্জলির সব গান তো আমার মনেই থাকে না।’ নজরুল তখন রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে একটি গান ও একটি কবিতার আবৃত্তি শুনতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও নজরুলের গান ও আবৃত্তি শোনার প্রতীক্ষায় ছিলেন। তাই নজরুলকেই তাড়াতাড়ি গান গাইতে বললেন,সেকি ! আমি যে তোমার কবিতা ও গানের অপেক্ষায় আছি। তাড়াতাড়ি শুরু করে দাও।’

নজরুল তখন একটা অন্তরস্পর্শী ভাব-ব্যঞ্জনা নিয়ে ‘অগ্নিবীনা’র ‘আগমনী’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। আবৃত্তির পরে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে গান গাওয়ার জন্য আহবান করলেন। নজরুল পুত্রবিয়োগ-ব্যথাবিধূর কণ্ঠে বিষাদঘন করুণ সুরে গেয়ে উঠলেন-

‘কোন্ সুদূরের চেনা বাঁশির ডাক শুনেছিস্ ওরে চখা
ওরে আমার পলাতকা!’

গানটি শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বাহ্ বেশ! এটি কবে লিখলে?’ তখন শহীদুল্লাহ্ সাহেব রবীন্দ্রনাথকে জানালেন, সম্প্রতি কাজী সাহেব তাঁর একটি শিশুপুত্রকে হারিয়ে এই শোকগাথাটি রচনা করে সান্ত্বনা খুঁজে ফিরছেন।’ এ কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ নীরব থেকে সমবেদনা প্রকাশ করলেন। নজরুল তখন রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠের একটি কবিতার আবৃত্তি ও একটি গান শুনতে চাইলে রবীন্দ্রনাথ সুললিত ও রমণীয় কণ্ঠে সম্প্রতি লেখা একটি গান কবিতায় আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন-

‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে
এল ফাগুন দিনের স্রোতে
এসে হেসেই বলে, ‘যাই যাই যাই।’

রবীন্দ্রনাথ যতক্ষণ আবৃত্তি করছিলেন, ততক্ষণই নজরুলের কালো বাবরি চুলের মাথাটি তালে তালে দুলছিল্ আবৃত্তি শেষ করেই রবীন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়ালেন।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাতে অনেক কথা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বলেছিলেন- শান্তিনিকেতনে থেকে যেতে। সেখানে তিনি ছেলে-মেয়েদের ড্রিল শেখাবেন আর দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গান শিখবেন। নজরুল এ প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। নজরুলের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন তিনি কোন পথের পথিক। নজরুলও সে প্রস্তাব গ্রহণ না করে ভাল করেছেন। তাঁর জীবনে তা প্রমাণিত হয়েছে।

উপরে আমরা জোড়াসাঁকো ও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের দুটো সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করেছি। জোড়াসাঁকোয় সাক্ষাৎকার যদি জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে হয় আর শান্তিনিকেতনের সাক্ষাৎকার তো অক্টোবরে হয়েছে বলে প্রভাতকুমার উল্লেখই করেছেন, তাহলে উভয় সাক্ষাৎকারের ব্যবধানে বেশি দিনের নয়। এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়। আমাদের বিভিন্ন লেখকদের ওপর নির্ভর করতেই হচ্ছে। তবে আমাদের কাছে মনে হয়, যেহেতু দুই সাক্ষাৎকারের ব্যবধান বেশি নয়, তাই যে কোনো এক জায়গায়ই রবীনদ্রনাথেরসঙ্গে প্রথমে দেখা হয়েছিল।

সেতুবন্ধনেধূমকেতু’ পত্রিকাঃ

চার চারটি পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ধূমকেতু পত্রিকাটি। ১৯২২ সালে ধুমকেতু নামে একটা পত্রিকায় ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে কাজী নজরুল লিখেছিলেন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। এই অপরাধে ১৩ মাস জেলে থাকতে হয়েছিল। বিচারাধীন বন্দি হিসাবে নজরুল ছিলেন প্রেসিডেন্সি জেলে, বিচার শেষে ১৭ জানুয়ারি নজরুলকে স্হানান্তর করা হয় আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে। পরাধীন জাতির সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণের চিএ তুলে ধরে বন্দী নজরুল সমগ্র দেশবাসীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন।

১৯২৩ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য নজরুলকে উৎসর্গ করে দেশবাসীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। রবীন্দ্রনাথ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ডেকে বলেন,

‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। সেখানা নিজের হাতে তাকে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমি যখন নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে পারছি না, ভেবে দেখলাম, তোমার হাত দিয়ে পাঠানোই সবচেয়ে ভালো, আমার হয়েই তুমি বইখানা ওকে দিও।’

এই বইটি নজরুলকে উৎসর্গ করায় রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী বেশ কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক খুশি হতে পারেননি। তাই রবীন্দ্রনাথ তাদের উদ্দেশ্যে বলেন,

‘নজরুলকে আমি ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গ পত্রে তাকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করেছি। জানি তোমাদের মধ্যে কেউ এটা অনুমোদন করতে পারনি। আমার বিশ্বাস, তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ। আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ ও রসের সন্ধান করনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।’

রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেন,

‘নজরুলের কাব্যে অসির ঝনঝনানি আছে। আমি যদি তরুণ হতাম তা হলে আমার কলমেও ওই একই ঝংকার বাজতো।’

পবিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে বইটি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন,

‘নজরুলকে বলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো, কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জোগাবার কবিও তো চাই।’

নজরুল বইটি পেয়েই বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে নজরুল লিখেছেন,

‘এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক আমায় উৎসর্গ করেন। তাঁর এই আশীর্বাদ-মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা ক্লেশ ভুলে যাই।’

রবীন্দ্রনাথের ‘বসন্ত’ উৎসর্গের পর, নজরুল আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বসে রচনা করেন -’আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ অর্থাৎ ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতা। নজরুল তার ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে উৎসর্গ করেন।

১৯২৩ সালে ১৪ এপ্রিল নজরুলকে হুগলী জেলে স্হানান্তর করা হয়। হুগলী জেলের সুপার মি. আর্সটান রাজবন্দীদের সাথে অত্যন্ত দূর্ব্যবহার ও অত্যাচার করতেন, রাজবন্দীদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে নজরুল জেলে ৪০ দিন অনশন করেছিলেন।

১৯২৩ সালের ১৭ মে শরৎচন্দ্র বাজে-শিবপুর হাবড়া থেকে লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে লিখেছেনঃ

‘হুগলী জেলে আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম উপুষ করিয়া মরমর হইয়াছে। বেলা ১টার গাড়ীতে যাইতেছি, দেখি যদি দেখা করিতে দেয় ও দিলে আমার আনুরোধে যদি সে আবার খাইতে রাজি হয়। না হইলে তার কোন আশা দেখি না। একজন সত্যিকার কবি। রবী বাবু ছাড়া আর বোধ হয় এমন কেহ আর এত বড় কবি নাই”। কিন্ত শরৎচন্দ্র দেখা করেত পারেন নি।

জেলের ভিতরে অনশনরত নজরুলের উপর অত্যাচার বেড়ে যায়। ডান্ডাবেড়ী, হ্যান্ডকাপ, সেল কয়েদ, ফোর্সড ফিডিং-এর চেষ্টা চলে, ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়েন নজরুল। মুমূর্ষ কবিকে বাঁচানোর জন্য শিলিং-এ চিঠি লেখা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, তিনি যেন নজরুলকে অনশন ভঙ্গ করতে অনুরোধ জানিয়ে পত্র লিখেন।

রবীন্দ্রনাথ পত্রের উত্তরে বিদ্রোহী-বিপ্লবী সৈনিক নজরুলের দৃঢ়তাকে সমর্থন জানিয়ে লিখেনঃ

“আদর্শবাদীকে আদর্শ ত্যাগ করতে বলা তাকে হত্যা করারই সামিল। অনশনে যদি কাজীর মূত্যুঘটে তা হলেও তার অন্তরে সত্য আদর্শ চিরদিন মহিমাময় হয়ে থাকবে।”

শেষ পর্যন্ত, স্নেহভাজন নজরুলের অনশনে বিচলিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাকে টেলিগ্রাম করেনঃ

Give up hunger strike, our literature claims you

অত্যন্ত বিস্ময়ের বিষয়, জেল কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রনাথের টেলিগ্রাম নজরুলকে না দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে লিখে পাঠালেন- “Addressee not found.” রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম ফেরত পেয়েই বুঝলেন এটি সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত ও হীনম্মন্যতা। অনশনের চল্লিশ দিনে বিরজাসুন্দরী দেবীর হাতের লেবুর রস পান করে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন।

১৯২২ থেকে১৯২৬ সাল পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার জন্য রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত লেখা পাঠিয়েছিলেন। ধূমকেতুতে নিয়মিত লেখা পাঠানো নজরুলে সাহসীকতার পুরষ্কারই ছিলো। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় একটি লেখা পাঠিয়েছিলেন যেটি উল্লেখ না করলেই নয়।

কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু,
‘আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ্‌ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয়-কেতন।
অলক্ষণের তিলক-রেখা
রাতের ভালে হোক-না লেখা–
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন।’
২৪ শে শ্রাবণ ১৩২৯
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সম্পর্ক যখন কাব্য ও সাহিত্যের ভাজে ভাজেঃ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘১৪০০ সাল’ কবিতা লেখেন ১৩০২ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে। কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষের পরের পাঠককে বসন্তের পুষ্পাঞ্জলি পাঠিয়েছেন।

আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতুহলভরে, আজি হতে শতবর্ষ পরে!

কাজী নজরুল ইসলাম ১৩৩৪ সালের আষাঢ় মাসে তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতায় এর উত্তর লেখেন। তাতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভক্তি।

আজি হ’তে শতবর্ষ আগে
কে কবি, স্মরণ তুমি করেছিলে আমাদেরে
শত অনুরাগে,
আজি হ’তে শতবর্ষ আগে!

রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের মনোভাবের অকৃত্রিম পরিচয় ফুটে উঠেছে কবিতাটিতে।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এর মধ্যে সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধা ও ভালবাসার তা নিয়ে এই লেখা। নজরুলের “তীর্থ পথিক” কবিতা থেকে অংশ বিশেষ। যা রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন নজরুল। কবিতাটির অংশ বিশেষঃ

তুমি স্রষ্টার শ্রেষ্ট সৃষ্টি বিশ্বের বিস্ময়,-
তব গুণ-গানে ভাষা-সুর যেন সব হয়ে যায় লয়।
তুমি স্মরিয়াছ ভক্তের তব, এই গৌরবখানি
রাখিব কোথায় ভেবে নাহি পাই, আনন্দে মূক বাণী।
কাব্যলোকের বাণী-বিতানের আমি কেহ নহি আর,
বিদায়ের পথে তুমি দিলে তবু কেন এ আশিস-হার?
প্রার্থনা মোর, যদি আরবার জন্মি এ ধরণীতে-
আসি যেন গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে!!

১৯২৩ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য নজরুলকে উৎসর্গ করে দেশবাসীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘বসন্ত’ উৎসর্গের পর, নজরুল আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বসে রচনা করেন -’আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ অর্থাৎ ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতা। নজরুল তার ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে উৎসর্গ করেন। নজরুলের অগ্নি-বীণা, দোলন-চাঁপা, ছায়ানট, সর্বহারা, ফণি-মনসা, সিন্ধু-হিন্দোল, চিত্তনামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের বাছাই করা কবিতা নিয়ে ১৯২৮ সালে ‘সঞ্চিতা’ প্রকাশ হয়। নজরুল ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ পত্রে লিখেছেনঃ

‘বিশ্বকবি সম্রাট শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রী শ্রীচরণারবিন্দেষু।।’

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নজরুল কয়েকটি কবিতা লিখেছেন। এসব কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুলের ‘অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলী’ ও ‘কৈশোর রবি’ কবিতা দুটি রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে লেখা।

‘অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলী’ কবিতাটির রবীন্দ্রনাথের আশিতম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে রচিত-

চরণারবিন্দে লহ অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলী,
হে রবীন্দ্র, তব দীন ভক্ত এ কবির।
অশীতি-বার্ষিকী তব জনম-উৎসবে
আসিয়াছি নিবেদিতে নীরব প্রণাম।
হে কবি-সম্রাট, ওগো সৃষ্টির বিস্ময়,
হয়তো হহনি আজো করুণা-বঞ্চিত!
সঞ্চিত যে আছে আজো সৃষ্টির দেউলে
তব স্নেহ করুণা তোমার, মহাকবি!….
(নতুন চাঁদ, অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলী)

‘কিশোর রবি’ রবীন্দ্র প্রশস্তিমূলক কবিতা –

হে চির-কিশোর রবীন্দ্র, কোন রসলোক হতে
আনন্দ-বেণু হাতে হাতে লয়ে এলে খেলিতে ধুলির পথে?
কোন সে রাখাল রাজার লক্ষ ধেনু তুমি চুরি করে
বিলাইয়া দিলে রস-তৃষা তুরা পৃথিবীর ঘরে ঘরে ।
কত যে কথায় কাহিনীতে গানে সুরে কবিতায় তব
সে আনন্দ-গোলেকের ধেণু রূপ নিল অভিনব।
ভুলাইলে জরা, ভুলালে মৃত্যু, অসুন্দরের ভয়
শিখাইলে পরম সুন্দর চির-কিশোর সে প্রেমময়।
নিত্য কিশোর আত্মার তুমি অন্ধ তুমি বিবর হতে
হে অভয়-দাতা টানিয়া আনিলে দিব্য আলোর পথে।
(নতুন চাঁদ, কিশোর রবি)

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও জীবন নজরুল উপলদ্ধি করেছেন প্রসারতায়। তাইতো রবীন্দ্রনাথের জন্মতিথি নিয়ে তিনি লিখলেন, ‘রবির জন্মতিথি’-

নিরক্ষর ও নিস্তেজ বাংলায়
অক্ষর-জ্ঞান যদি সকলেই পায়,
অ-ক্ষর অ-ব্যয় রবি সেই দিন
সহস্র করে বাজাবেন তাঁর বীণ।
সেদিন নিত্য রবির পুণ্য তিথি
হইবে।মানুষ দিকে তাঁকে প্রেম-প্রীতি।
(শেষ সওগাত, রবির জন্মতিথি)

রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক সৌহার্দ্যের; রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে যে কি স্নেহ করতেন তার একটি উদাহরণ রবীন্দ্রনাথের “গোরা” উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবিতে নজরুলকে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে মনোনীত করেন নরেশচন্দ্র মিএ। তখন সুরকার হিসাবে নজরুলের জনপ্রিয়তা সবার উপরে। চলচ্চিত্রটি যখন মুক্তি পেতে যাচ্ছে, তখন বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড থেকে আপত্তি ওঠে যে বোর্ডের অনুমতি না নিয়ে ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত (৭টি রবীন্দ্রসঙ্গীত) ব্যবহার করা হয়েছে এবং সুরও যথাযথ নয়; অতএব ছবিটি মুক্তি পেতে পারে না। প্রযোজকের মাথায় হাত। নজরুল কালক্ষেপন না করে ফিল্মের পিন্ট ও প্রজেক্টার নিয়ে ট্যাক্সি করে শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছে চলে গেলেন। সবশুনে রবীন্দ্রনাথ বললেন ‘কি কান্ড বলতো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান, আর ওরা কোন আক্কেলে তার দোষ ধরে? তোমার চেয়েও আমার গান কী তারা বেশি বুঝবে? আমার গানের মর্যাদা কী ওরা বেশী দিতে পারবে’? একথা বলে আগের থেকে লিখে রাখা অনুমতিপএ নিয়ে তাতে সই ও তারিখ দিয়ে দিলেন।

নজরুল রবীন্দ্র-স্নেহ থেকে কোনদিন বঞ্চিত হননি। এটি তার একটি বড় প্রমাণ।

১৯২১-এর ডিসেম্বর মাসে বিদ্রোহী কবিতা রচনা করে নজরুল সরাসরি চলে যান জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। উচ্চকণ্ঠে দে গরুর গা ধুইয়ে’ গাইতে গাইতে নজরুল ঠাকুর বাড়িতে প্রবেশ করে ডাকলেন গুরুদেব আমি এসেছি। উচ্চস্বরে আবৃত্তি করতে থাকেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি।

তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেন,

গুরুদেব আমি আপনাকে খুন করবো। রবীন্দ্রনাথ ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুনে কবিতার প্রশংসা করেন এবং নজরুলকে জড়িয়ে ধরে বলেন ‘সত্যিই তুই আমাকে খুন করেছিস’।

১৯২২-এর ২৫ জুন কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত স্মরণে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঐ স্মরণসভায় নজরুলকে ডেকে পাশে বসিয়েছিলেন। নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন ‘সত্যকবি’ কবিতাটি। রবীন্দ্রনাথ এভাবে নজরুলকে স্নেহ বন্ধনে আবদ্ধ করায় তখনও কবি-সাহিত্যিকরা ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন।

রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক পরে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে কিন্তু দুই কবির শ্রদ্ধা ও স্নেহের মৌলিক সম্পর্ক কখনও বিচলিত হয়নি।

বস্তুত, শনিবারের চিঠি’র সজনীকান্ত দাশ এবং মোহিতলাল মজুমদারের ঈর্ষান্বিত প্রয়াসে আধুনিক সাহিত্য নিয়ে বির্তক আর বঙ্গসাহিত্যে খুনের মামলা নিয়ে ভূল বুঝাবুঝি ছাড়া ১৯২০ থেকে ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পূর্ব কাল পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক ছিল স্নেহ ও শ্রদ্ধার।

পরিবারের সাথে বিদ্রোহী কবি

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের দার্জিলিংয়ে দেখা হয়। এ সময় নজরুল প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো ইতালি গেছেন সেখানে কবি দ্যনুনজিও’র সঙ্গে দেখা হয়েছিল কি না? রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন দেখা হবে কি করে তিনি যে তোমার চেয়েও পাগল।

নজরুল ১৯৩৫-এর জুন মাসে ‘নাগরিক’ পত্রিকার জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা চেয়ে চিঠি পাঠান। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ৭৫ বছর। বেশ অসুস্থ। এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৬-এর ১ সেপ্টেম্বর লিখেছিলেন,

‘তুমি তরুণ কবি, এই প্রাচীন কবি তোমার কাছে আর কিছু না হোক করুণা দাবি করতে পারে। শুনেছি বর্ধমান অঞ্চলে তোমার জন্ম। আমরা থাকি পাশের জিলায় (বীরভুমের বোলপুরে)। কখনো যদি ঐ

পেরিয়ে আমাদের এদিকে আসতে পারো খুশি হব।’

উক্ত চিঠির জবাবে নজরুল ‘নাগরিক’ পত্রিকায় লেখেন, কবিতাঃ

হে কবি, হে ঋষি অন্তর্যামী আমারে করিও ক্ষমা।
পর্বত-সম শত দোষত্রুটিও চরণে হল জমা।
তুমি শ্রষ্টার শ্রেষ্ঠ বিস্ময়-
তব গুণে-গানে ভাষা-সুর যেন সব হয়ে যায় লয়।
প্রার্থণা মোর, যদি আরবার জন্মি এ ধরণীতে,
আসি যেন শুধু গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে।

রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা ও নাটকে কোথাও কোথাও বৈপ্লবিক চেতনার একটি রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। তাঁর রথের রশি, ওরা কাজ করে, বাঁধ ভেঙে দাও’ ‘তাসের দেশ’ বা ‘রক্ত করবী’তে বিপ্লবীর বাণী তো আছেই। নজরুল এ থেকেও কিছুটা হলেও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এমন তো ভাবাই যায়।

মানুষ, মানবতা নিয়ে দুজনের ভাবনায় কোনো প্রভেদ নেই। নেই ধর্মপরিচয়ের বাইরে মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখার।

রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’। বলেন, মানবিক ধর্মের কথা যা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উর্ধ্বে। একইভাবে নজরুল বলেন, ‘আমি আজও মানুষের প্রতি আস্থা হারাইনি। মানুষকে আমি শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি। শ্রষ্টাকে আমি দেখিনি কিন্তু মানুষকে আমি দেখেছি। এই ধূলিমাখা, অসহায়, দুঃখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করবে।’

নজরুল লিখেন, গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ সেই চিরায়ত উপলব্ধি-‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’

সাম্য, মৈত্রী, মানবপ্রেম তথা মানবিকতার প্রকাশে যেমন রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে বাস্তবে অগ্রনায়ক, রাজনৈতিক বিষয়-সংলগ্ন হয়েও তেমনি নজরুল। রবীন্দ্রনাথ যুদ্ধ বিরোধী, শান্তিবাদী, বিশ্বনাগরিক এবং মানবপ্রেমী। তার বহু রচনায় এমন প্রমাণ মেলে। নজরুলের মানবিক চেতনা সাম্যবাদী চেতনার সঙ্গে এক হয়েছে তৃণমূল স্তরের সাধারণ মানুষের কল্যাণে।

কাজী নজরুল ইসলাম গুরু বলে মান্য করতেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। নজরুল নিজের কাব্য চর্চা থেকে অন্যত্র মনোনিবেশ করায় রবীন্দ্রনাথ কাজী নজরুলকে বলেছিলেন, তুমি নাকি এখন তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাছো?’ নজরুল উত্তরে লিখেছিলেন, গুরু কন আমি নাকি তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাছি…।’

১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট বাংলা ১৩৪৮ সালের ২২শে শ্রাবণ বেলা বারোটা এগারো মিনিটে রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ ঘটলো। কবিগুরুর আত্মা মর্ত থেকে উর্ধ্বে উঠে গেল-দেশ শূন্য, কাল শূন্য-মহাশূন্য পরে। বৈশাখের শঙ্খ স্তব্ধ হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের মূত্যু সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল লেখনী হাতে তুলে নিলেন। রচনা করেন শোক কবিতা ‘রবি হারা’-

দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্ত পথের কোলে
শ্রাবণ মেঘ ছুটে’ এল দলে দলে
উদাস গগন-তলে।
বিশ্বের রবি ভারতের কবি,
শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি।
তুমি চলে যাবে বলে।…
বিদায়ের বেলা চুম্বন লয়ে যায় তব শ্রীচরণে,
যে লোকেই থাক হতভাগ্য এ জাতিরে রাখিও মনে।
(রবি হারা, সওগাত, ভাদ্র ১৩৪৮)

কলকাতা বেতার কেন্দ্রে এই কবিতাটি নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন। রবীন্দ্র-প্রয়াণ নজরুলের মানসিক অবস্থা এ কবিতার মাধ্যমে বুঝা যায়। রবীন্দ্রনাথের মূত্যুর পর নজরুল ‘সালাম অস্ত-রবি’ নামে আরও একটি কবিতা লিখেছিলেন। এই কবিতাটি ও কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। এছাড়া লেখেম ‘ঘুমাইতে দাও শান্ত রবীরে।’

শত রূপে রঙে লীলা-নিকেতন আল্লার দুনিয়াকে
রাঙায় যে জন, আল্লার কৃপা সদা তাঁরে ঘিরে থাকে।
তুমি যেন সেই খোদার রহম এসেছিলে রূপ ধরে,
আশেরি ছায়া দেখাইয়াছিলে রূপের আর্শি ভরে।
কালাম ঝরেছে তোমার কলমে, সালাম লইয়া যাও
উর্ধ্বে থাকি’ এ পাষাণ জাতিরে রসে গলাইয়া দাও!
(সালাম অস্ত-রবি, মাসিক মোহাম্মদী, ভাদ্র ১৩৪৮)

রবীন্দ্রনাথের মূত্যুতে শোকাহত দেশবাসীর উদ্দেশ্যে নজরুল গানও রচনা করেছিলেন:

“ঘুমাইতে দাও, শান্ত রবিরে জাগায়োনা।
সারা জীবন যে আলো দিল ডেকে তার ঘুম ভাঙ্গায়োনা।

গানটি অত্যন্ত বেদনাময় আবহের। নজরুল এই গানটি সুনীল ঘোষ, ইলা ঘোষ প্রমুখ শিল্পীকে দিযে রেকর্ড করেছিলেন। গানটি কলকাতা বেতারেও প্রচারিত হয়েছিল। সেদিন নজরুল লিখলেন –

‘বিশ্বের কবি,ভারতের রবি,শ্যামল বাংলার হৃদয়ের ছবি,তুমি চলে গেলে, তোমাকে নিয়ে কত গর্ব করেছি, ভগবান তোমাকে পাঠিয়েছিল আবার ফিরিয়ে নিল কেন? বিদায়ের সময় তোমার পায়ে আমার চুম্বন নিয়ে যাও। কথা দাও যেখানেই থাক এই হতভাগ্য বাঙ্গালী জাতিকে মনে রাখিও।’

নজরুল রবীন্দ্রনাথকে কতটাশ্রদ্ধা করতেন তার প্রমাণ পাই। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছর পরেই নজরুল চিরতরে অসুস্থ এবং ক্রমান্বয়ে সম্বিতহারা ও নির্বাক হয়ে যান। বাংলার দুই মহান কবির কণ্ঠ প্রায় একই সময়ে নীরব হয়ে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে স্বপরিবারে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ধানমন্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি প্রদান করেন। প্রেম, দ্রোহ, সাম্য ও জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের আগষ্টে (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র) ঢাকার পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) ৭৭ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই।’ কবির ইচ্ছানুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

অসুস্থ জাতীয় কবির শয্যাপাশে বঙ্গবন্ধু

রবীন্দ্রনাথ-নজরুল বাঙালি জাতি ও বাংলার দুই মহান ব্যক্তি। তাঁদের মহত্ব বাঙালির গর্বের ধন। একজন আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা, অপরজন আমাদের জাতীয় কবি।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল জন্মগতভাবে ভারতবর্ষের অহিংসার দর্শনভূমিতে গড়ে উঠেছেন। এখানে সভ্যতার ক্রমবিকাশে বাঙালী সংস্কৃতি হয়েছে সুসংহত। তাই তাদের জীবন অহিংসার বন্ধনে আবদ্ধ এবং আজও দৃষ্টান্ত।

আজকাল কিছু নব্য এবং উঠতি মূর্খ কবি বা সাহিত্যিককে বলতে শুনি কাজী নজরুলকে হিংসা করতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অথবা আরো নিকৃষ্টভাবে এই মহান দুই কবির সম্পর্ককে হেয় করা হয়। সাধারণের মাঝে হিংসার বীজ বপন করাই এদের মূল লক্ষ্য। তাদের জ্ঞানের পরিধী এবং পড়াশুনা কতটুকু কিংবা তাদের মানসিকতা কতখানি নিচু তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এদের প্রতি তীব্র ঘৃণা জানানো ছাড়া আর কিছুই বলার নেই। আলোচ্য প্রবন্ধটি তথ্যসূত্রে বর্ণিত প্রবন্ধগুলো সহ অনেকগুলো প্রবন্ধের সার সংক্ষেপ। কিছুক্ষেত্রে হুবহু বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে কয়েকটি প্রবন্ধের।

নজরুল চর্চা ও দুএকটি প্রসঙ্গ

বেঁচে থাকলে কাজী নজরুল ইসলামের বয়স হতো এখন ১১৫। অর্থাৎ এ-বছর আমরা বিদ্রোহীকবির ১১৬তম জন্মদিবস পালন করেছি। কবির জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশে দীর্ঘকালীন প্রস্ত্ততিপর্বের ফলস্বরূপ আমরা কবিকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের অজস্র কর্মসূচি পালনের সাফল্যও সংবাদ এ-পার বাংলায়ও বসে নানা সময়ে পেয়েছিলাম। তুলনায় পশ্চিমবাংলায় বা ভারতের অন্যত্র শতবর্ষে বা তারপরে কাজী নজরুলের সাহিত্য ও সৃষ্টি সংরক্ষণ বা শ্রদ্ধার্ঘ্য বিষয়ক বহুবিধ কর্মসূচি পালনের সংবাদ দেশের বাইরে অন্যত্র কমই পৌঁছেছে।

বিদেশে তো প্রায় কোথাও সে-সব নজরে পড়েনি। ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। সেখানকার খবরাখবর ইংল্যান্ড, জার্মানিসহ সর্বত্রই পাওয়া গিয়েছিল। কাজী নজরুল ইসলাম এখন বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে সম্মানিত। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে চুরুলিয়ার ভূমিপুত্র এই কবিকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়েছিল। পরের মাসেই কবি স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘একুশে পদক’ স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন। বাংলাদেশে আসার পর ঢাকার পিজি হাসপাতালে ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ রোববার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে কবি ৭৭ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ-সংলগ্ন প্রাঙ্গণে কবিকে সমাহিত করা হয়। প্রয়াণের পরের বছরেই ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রয়াত কবিকে জাতীয় কবির সম্মানের কথা প্রথম ঘোষণা করেন। ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাঙালির এই প্রিয় কবির সম্মান এরপর দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কবির বিষয়ে সর্বত্র গভীর আগ্রহ এতে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

কবির জন্মস্থান পশ্চিমবাংলায়। বলতে গেলে সেখানেই তাঁর সৃষ্টিশীল সমগ্র জীবনটাই কেটেছিল। সেখানেই তাঁর সঙ্গীসাথিরা প্রয়াণের পরেও তখনো অনেকেই বেঁচে ছিলেন। তাঁদের অনেকেই তখনো সাহিত্য, শিল্প-সংগীতের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সক্রিয় ও খ্যাতির শীর্ষে। ফলে কবির প্রয়াণকালে তাঁদের মানসিক প্রতিক্রিয়া সহজেই অনুধাবন করা গিয়েছিল। ২৯ আগস্ট ১৯৭৬। মনে আছে, সেদিন দুপুরে প্রথম আকাশবাণী দিল্লি থেকে সংবাদটি এখানে বিলম্বে প্রথম প্রচারিত হয়েছিল। নানা ভাষায় সংবাদটি বিশাল ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। কলকাতায় আকাশবাণী কেন্দ্র থেকেও একের পর এক সংবাদ বুলেটিন প্রচারিত হতে থাকে। ভারতবর্ষের সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে।  বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গের নজরুলপ্রিয় বাঙালি সমাজ এ-খবর পেয়ে শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ে হৃদয়-উৎসারিত বেদনার হাহাকার। পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্রই। সারাদিন সকলেই কবির দেহ চুরুলিয়ায় প্রত্যাগমনের আশায় পথ চেয়ে সেদিন অপেক্ষায় ছিলেন। কবির পুত্র সব্যসাচী তাঁর পিতার প্রয়াণ সংবাদ প্রথম অবশ্য জানতে পারেন বেলা প্রায় সাড়ে ১০টায়। বাংলাদেশ রেডিওতে খবরটা শুনে সব্যসাচীর বন্ধুরা তাঁকে টেলিফোনে এই দুঃসংবাদ জানায়। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে যান কলকাতাস্থ বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রদূত অফিসে। সেখানেও মৃত্যু সম্পর্কে নাকি তখনো তেমনভাবে কিছু জানা যায়নি। কলকাতার আকাশবাণী থেকে খবর যায় সব্যসাচীর বাড়িতে এবং ছোট পুত্র অনিরুদ্ধের পাইকপাড়ার বাসায়। অনিরুদ্ধপত্নী কল্যাণী ও তাঁর পুত্র কাজী অরিন্দম তখনো বাড়িতে ছিলেন না। তাঁরা মিনার্ভা থিয়েটার হলে গিয়েছিলেন একটি অনুষ্ঠানে। সেখানে কিশোর পুত্র অরিন্দম পুরস্কার আনতে গিয়েছিল মায়ের সঙ্গে। ফলে অনিরুদ্ধ-জায়া কল্যাণী কাজীও খবর পান প্রথম বেলা প্রায় ১১টায়। বাংলাদেশ থেকে কেউ কবির অসুস্থতা বা প্রয়াণ সংবাদ সেদিন সরাসরি কবিপুত্রকে জানাননি। বাধ্য হয়েই সব্যসাচী প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাঁর ভবানীপুরের বেলতলা রোডের বাড়িতে যান। মুখ্যমন্ত্রী তখন ছিলেন বর্ধমান জেলার বার্নপুরে। চুরুলিয়া থেকে বার্নপুর প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে। সেখানে কবির চুরুলিয়ার ভ্রাতৃষ্পুত্ররা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন বলে পরে জানা যায়। কিন্তু কবির মরদেহ কলকাতায় ফিরিয়ে আনার আবেদনে সেদিন মুখ্যমন্ত্রীর তরফে নাকি তেমন আন্তরিক উদ্যোগ দেখা যায়নি। কলকাতায় কবির ভক্তরা অবশ্য শেষ দর্শনের আশায় মধ্য কলকাতায় সব্যসাচীর ক্রিস্টোফার রোডের ফ্ল্যাটের সামনে দলে দলে গিয়ে ভিড় করতে থাকেন।

বাধ্য হয়েই সব্যসাচী বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে এ-বিষয়ে সেদিন পুনরায় আবেদন জানান। তখন দেখা গেল, সব্যসাচীর পাসপোর্টটি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও দূতাবাস কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত কবিপুত্র সব্যসাচী ও কবির কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীকে দুপুরের বিমানযোগে দমদম থেকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। সেদিন পশ্চিমবঙ্গের তথ্যবিভাগের তদানীন্তন রাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় দিল্লিতে যোগাযোগ করে এ-বিষয়ে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেও সফল হননি। বস্ত্তত দিল্লি কর্তৃপক্ষের সেদিন এ-ব্যাপারে তেমন আগ্রহ বা সাড়া মেলেনি। সব্যসাচী ও কল্যাণী একই সঙ্গে এ-বিষয়ে  অর্থাৎ চুরুলিয়ায় নিজ জন্মস্থানে কবিকে এনে কবর দেওয়ার আবেদন জানিয়ে চিফ সেক্রেটারির সঙ্গেও যোগাযোগ করেন।

দুর্ভাগ্যবশত সেদিন দুপুরের বিমান কলকাতা থেকে ছাড়তেও বিলম্ব হয়। তাঁরা ঢাকা বিমানবন্দরে গিয়ে তাই বলতে গেলে প্রায় শেষ মুহূর্তেই পৌঁছান। সংবাদে প্রকাশিত, ‘কবির জ্যেষ্ঠপুত্র কাজী সব্যসাচী, কনিষ্ঠ পুত্র অনিরুদ্ধের স্ত্রী কল্যাণী কাজী প্রভৃতি আত্মীয়বর্গ আজ রাতে ঢাকায় পৌঁছেছেন বলে বাংলাদেশ থেকে জানানো হয়েছে।’ (যুগান্তর, কলকাতা, ৩০ আগস্ট ১৯৭৬)।

কবিপুত্র কাজী সব্যসাচী পরদিন সোমবার সন্ধ্যায় কলকাতায় ফিরে  আসেন। এসেই বিষণ্ণমুখে সংবাদদাতাদের জানিয়েছিলেন, ‘মা রইলেন চুরুলিয়ায় আর বাবা রইলেন ঢাকায়। এ আক্ষেপ সারাজীবন থাকবে।’ বারবার কবিপুত্র বলতে লাগলেন, ‘ওরা আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই শেষ দেখা দেখতে পেতাম। আর ওদের এতো তাড়াহুড়ো করারই বা দরকার কী ছিল। ওদের জানানো হয়েছিল যে কবিপুত্র ঢাকা যাচ্ছেন দুপুরের প্লেনে। তবু কিসের এত তাড়াহুড়ো?…’

পশ্চিমবাংলার নজরুল অনুরাগী সাধারণ মানুষের আক্ষেপ ছিল, আজ সম্ভবত বঙ্গবন্ধু থাকলে এমনটি হতো না। অবশ্য সেই রোববার বিকেলে ঢাকায় পৌঁছে সব্যসাচী বিমানবন্দর থেকে সোজা কল্যাণী কাজীসহ কবির কবরস্থানে গিয়ে দ্রুত হাজির হয়েছিলেন। তখন বাংলাদেশের সময় সোয়া ৬টা। তাঁর কথা অনুযায়ী, তার মিনিট কয়েক আগেই কবিকে মাটি দিয়ে সকলে চলে গেছেন। কবির একমাত্র জীবিত পুত্র সব্যসাচী কবরে একমুঠো মাটিও তাই দিতে পারলেন না। সকলের অজান্তে কবির কবরে কবিপুত্রের দুচোখের জল ঝরে পড়ল। মাটি কি অশ্রুজলের চেয়েও দামি!

পরদিন কলকাতায় দৈনিক যুগান্তরের (সম্পাদক : সুকমলকান্তি ঘোষ) হেডলাইন ছিল – নজরুল নেই \ প্রবাসে জীবনাবসান

কবির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার সমস্ত সরকারি অফিস এবং স্কুল-কলেজে পরদিন সোমবার ছুটি ঘোষণা করেছিল। পত্রিকার পাতা জুড়ে কবির বিয়োগ সংবাদ। এছাড়াও ছিল প্রবোধ সান্ন্যাল, অন্নদাশঙ্কর রায়, মনোজ বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়সহ অন্যান্য কবিবন্ধুর রচনা ও শ্রদ্ধাঞ্জলিতে পত্রিকার পৃষ্ঠা ভরা। সেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর শোকবার্তায় বলেছিলেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম আর নেই – এই সংবাদে আমি গভীর মর্মাহত। ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্যে তিনি বহু বছর ধরে বাকশক্তিহীন। কিন্তু সক্রিয় জীবনে তিনি যা লিখেছেন তাতে বাংলা সাহিত্যে তিনি অমর। কবির জাতীয়তাবাদী কবিতা লক্ষ লক্ষ লোককে নিঃস্বার্থ ও দুঃসাহসী কাজে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর মৃত্যুতে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। কবির নিকট আত্মীয়বর্গ এবং বাংলা ভাষায় যাঁরা অনুরাগী তাঁদের প্রতি আমি আন্তরিক সমবেদনা জানাই।’

মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় তাঁর শোকবার্তায় জানান, ‘বাংলার বিদ্রোহী কবি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। একথা বিশ্বাস করা কষ্টসাধ্য। কবি নজরুল তাঁর কবিতায় ও গানে মানুষের শুধু প্রাণই ভরাননি, মানুষকে নতুন প্রেরণার জাতীয় চেতনায় উদ্দীপিত করেছিলেন। তাই তিনি বাঙালি-হৃদয়ে তথা ভারতবাসীর হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন। তাঁর কবিতা ও গান চিরকাল আমাদের ঘরে ঘরে পল্লী প্রান্তরে অনুরণিত হবে। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত মানুষের সঙ্গে আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের অমর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করছি।’ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী কবির দেহ তাঁর জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দিল্লির অনুমতি আনার বিষয়ে কেন তেমন উদ্যোগী হলেন না? সেদিন কবির মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি দেবকান্ত বড়ুয়া, সাংসদ মায়া রায় (মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী), সাংসদ প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী, পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কর্মসমিতি, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, ড. প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র, ফজলুর রহমান, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অরুণ কুমার মৈত্র, এসইউসি, ভারতীয় জনসঙ্ঘ, শিশির কুমার ইনস্টিটিউট, ডিওয়াইও, ডিএসও-সহ অসংখ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। শোকসভার আয়োজন হয়েছিল চুরুলিয়া নজরুল অ্যাকাডেমি এবং আসানসোল প্রেস ক্লাবেও।

কলকাতার দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে আকর্ষণীয় শিরোনাম ছাপা হয়েছিল। যেমন – চিরনিদ্রায় চিরবিদ্রোহী বীর, সহধর্মিণী একাকী শায়িত রইলেন, ইন্দিরা মর্মাহত, সব্যসাচীরা ঢাকা গেলেন, শোকাশ্রু, স্মৃতিভারে পড়ে আছেন (ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা) ইত্যাদি। প্রতিটি পত্রপত্রিকায় সম্পাদকীয় ছাড়াও একাধিক লেখা হয়েছিল তাঁকে নিয়ে সপ্তাহজুড়ে।

পরের দিন কলকাতায় রবীন্দ্রসদনে এক স্মরণসভায় সোমবার পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকবৃন্দ নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। সেই সভায় উপস্থিত থাকার সময় দেখেছিলাম প্রেক্ষাগৃহ পরিপূর্ণ। দেখেছি অসংখ্য মানুষ রবীন্দ্রসদনের বাইরে সেদিন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছেন। হলের দরজা বাধ্য হয়েই খোলা রাখতে হয়েছিল। শোকসভার আহবায়ক ছিলেন কলকাতার শেরিফ রঘুনাথ দে। সভায় পৌরোহিত্য করেন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। কবির বন্ধুরাও সেখানে প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলেন। লেখক সমাজের সকলেই সভায় এসে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। শিল্পীরা শ্রদ্ধা জানান কবিকে গানের মাধ্যমে। ঢাকা থেকে সরাসরি রবীন্দ্রসদনে এসে উপস্থিত হন কবিপুত্র সব্যসাচী ও পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীও। কল্যাণী মঞ্চে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি কাঁদছিলেন আর বলছিলেন – ‘এত করে ছুটে গেলাম, বাবাকে শেষবারের মতো একটু দেখতেও পেলাম না।’ না, ওদের কেউ ডাকেনি। শোক-সমবেদনাও জানায়নি। শুধু সমরবাবু  (ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত) ছিলেন। ঢাকায় সব্যসাচী ও কল্যাণীকে তিনি সে-রাতে আতিথ্যদান করেছিলেন।

সমাবেশে সকলেই আবেগে তখন বেশ বিচলিত। ড. রমা চৌধুরীর বুকে মাথা রেখে মঞ্চে তখন কেঁদেই চলেছেন কবির পুত্রবধূ। সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তাকে মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। মঞ্চে উপস্থিত বিচারপতি শঙ্করপ্রসাদ মিত্র, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায়, শিক্ষামন্ত্রী মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ বসু, স্পিকার অপূর্বলাল মজুমদার, বিচারপতি মাসুদ, শেখ আনোয়ার আলি, তুষারকান্তি ঘোষ, প্রবোধকুমার সান্ন্যাল, উপাচার্য সতেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ বিদ্বজ্জন।

কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে সকলেই কবির মৃতদেহ তাঁর জন্মস্থানে পত্নীর কবরের পাশে না আনায় হতাশা ব্যক্ত করেন। লেখক মনোজ বসু ও শেখ আনোয়ার আলি নজরুলের মরদেহ এখানে আনা যায়নি বলে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন।

স্মরণানুষ্ঠানে প্রবীণা নজরুলশিষ্য শিল্পী আঙ্গুরবালা চোখের জল মুছতে মুছতে গেয়ে শোনান – ‘ওগো পূজার থালায় আছে আমার ব্যথার শতদল’। শিল্পী বীরেন্দ্রচন্দ্রের গান – ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি’। সুপ্রভা সরকার গেয়েছিলেন – ‘অঞ্জলি লহ মোর সংগীতে’। সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় (ওরে নীল যমুনার জল), মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় (কে গো আমার সাঁঝ গগনে), অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় (দিতে এলে ফুল হে প্রিয় আজি সমাধিতে মোর), ধীরেন বসু    (শূন্য এ বুকে পাখি মোর) সেদিন রবীন্দ্রসদনে গানে গানে প্রয়াত কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।

মনে আছে, নজরুলের প্রয়াণের অনেক আগে ষাটের দশকে পূর্ববাংলায় নজরুলের অনুরাগী মহল ঢাকায় কবির প্রাণসখা কাজী মোতাহার হোসেনের বাসভবনে গড়ে তোলেন ‘ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন’। অবশ্য তারও আগে পঞ্চাশের দশকেই ঢাকায় প্রথম গড়ে উঠেছিল বুলবুল ললিতকলা একাডেমী। সেখানেই দেশভাগের পর প্রথম প্রথাগত নজরুলসংগীত শিক্ষাদানের সূচনা। ব্যক্তিগতভাবে আরো আগে অনেকেই সেখানে নজরুলের গানের শিক্ষকতা করতেন। ১৯৬৮ সালে ২৪ মে কবির জন্মদিনে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আনুষ্ঠানিকভাবে নজরুল একাডেমীর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সেখান থেকেই প্রকাশিত হতো নজরুল একাডেমী পত্রিকা নামে একটি মূল্যবান পত্রিকা। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এর মোট বারোটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। অবশ্য নজরুলচর্চার প্রথম সরকারি প্রতিষ্ঠান বলতে বোঝাত ১৯৬৪-৬৫ সালে কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ড। এটি পরে বাংলা একাডেমীর (একাডেমি) সঙ্গে মিশে যায়। সেখান থেকেই ১৯৬৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় আবদুল কাদিরের সম্পাদনায় প্রথম নজরুল রচনাবলী। মোট তিনটি খন্ডে – প্রথম খন্ড (১৯৬৬), দ্বিতীয় খন্ড (১৯৬৭) ও তৃতীয় খন্ড (১৯৭০) – তা প্রকাশিত হয়েছিল যা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে এর আরো খন্ড প্রকাশ পায়।

একথা অনস্বীকার্য যে, নজরুলকে নিয়ে এরপর স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও গভীর আগ্রহ ও জিজ্ঞাসার অন্ত নেই। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ‘জাতীয় কবি’ বলে স্বীকৃত ও সম্মানিত কবি নানাভাবেই বাংলাদেশে চর্চিত। তুলনায় কবির কর্মক্ষেত্র ও জন্মস্থান পশ্চিমবাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি বা পৃষ্ঠপোষকতার অভাব অবশ্যই বহুকাল নজরে পড়েছিল। কিন্তু আজকাল বাংলাদেশে কেউ কেউ প্রায়শই প্রচার করে থাকেন যে, পশ্চিমবাংলায় নজরুলচর্চা হয় না। পশ্চিমবঙ্গে নাকি নজরুলচর্চা বর্তমানে বলতে গেলে এক প্রকার স্থবির। নজরুলচর্চার বৈশ্বিক চিত্র আলোচনাকালে নির্দ্বিধায় তাই কেউ লিখেন, নজরুলের জন্ম ভারতে হলেও নজরুলচর্চা বর্তমানে সেখানে বিশেষ নেই বললেই চলে। সেখানে নজরুলচর্চা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, অনেকটা  অসংগঠিত। তবে ব্যক্তিগত আয়োজন এবং সংগঠন পর্যায়ের উদ্যোগ ও চর্চায় নজরুল কলকাতার সমাজে নিষ্প্রভভাবে বেঁচে আছেন। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নজরুল গবেষণা ও প্রকাশনা একেবারে নেই বলা চলে।… কলকাতায় গড়ে ওঠেনি কোনো নজরুলচর্চা কেন্দ্র। তবে ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেখানে ‘নজরুল চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পত্তন হয়।… ইত্যাদি…।

এসব লেখক পশ্চিমবঙ্গে বিগত ছয় দশকের নজরুলচর্চার বিষয়ে সম্ভবত কোনো খোঁজখবরই রাখেননি। তাই অবলীলায় কোনো তথ্য ছাড়াই এমন  অসতর্ক মন্তব্য করে চলেছেন। তাঁদের অবগতির জন্যে সবিনয়ে জানাতে হচ্ছে, কবির অসুস্থতার পর রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় এক দশক শুধু পশ্চিমবঙ্গই নয়, সর্বত্রই কিছুটা অন্তরালে কবি আলোচিত ছিলেন। স্বাধীনতার পর চিকিৎসার জন্যে বিদেশে (১৯৫৩) গেলেও তাঁকে সাত মাস পরেই কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়। সেই পর্বে কবি নিঃসন্দেহে এখানেও কিঞ্চিৎ আড়ালে ছিলেন।

১৯৫৫ সালে কবির সঙ্গী ও স্নেহভাজন প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক প্রকাশিত হয় কাজী নজরুল (প্রথম খন্ড)। ১৯৫৪ সালে আজহারউদ্দীন খান লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্যে নজরুল। মুজফ্ফর আহমদ এরপর লেখেন কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথা (১৯৬৫)। পাশাপাশি অশোক গুহের অগ্নিবীণা বাজান যিনি (১৯৬৮) এবং অশোককুমার মিত্রের নজরুল প্রতিভা পরিচিতি (১৯৬৯)। পুনরায় এভাবে শুরু হয় ব্যাপক নজরুলচর্চা।

এর আগেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও অনুরাগে পূর্ববাংলা থেকে গোড়ায় প্রকাশিত হয়েছিল আবুল ফজলের গ্রন্থ, বিদ্রোহী কবি নজরুল (১৯৪৭)। আবদুল কাদিরের নজরুল জীবনী (১৯৪১) কলকাতা থেকে প্রথমে প্রকাশিত হলেও লেখকের নজরুলবিষয়ক দ্বিতীয় গ্রন্থ নজরুল জীবন ও সাহিত্য (১৯৪৮) দেশভাগের পর প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে। অসুস্থ হওয়ার পরই পূর্ববাংলায় নজরুলকে নিয়ে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশনা শুরু।

অবশ্য পূর্ববাংলায় নজরুলের গান প্রথম থেকেই অনেক বাড়িতে গাওয়া হতো। কিন্তু আজ এ-কথা  মানতেই হবে যে, নির্বাক নজরুলের জীবনে তাতে কিছুটা ভাটা পড়ে। কিন্তু এরপর মধ্য পঞ্চাশ থেকে পশ্চিমবাংলার সর্বত্র নজরুলের গানের পুনরুজ্জীবন ঘটে। নজরুলের ঘনিষ্ঠ নজরুল গানের প্রধান শিল্পীরা অধিকাংশই কলকাতায় থাকায় তাঁদের কণ্ঠের নজরুলসংগীত পুনরায় দুই বাংলার শ্রোতাদের কাছে সহজেই পৌঁছে যেতে সমর্থ হয়। কবির কাছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, কমলা ঝরিয়া, রাধারানী দেবী, দীপালী তালুকদার, পদ্মরানী চট্টোপাধ্যায়, গীতা বসু, ইলা ঘোষ, সুপ্রভা সরকার, প্রতিভা বসু (সোম), হরিমতী, যুথিকা রায়, কানন দেবী, শৈল দেবী ও পারুল সেনসহ সকলেই পশ্চিম বাংলায়ই নিয়মিত নজরুলের গান তখন পরিবেশন করে গেছেন। পাশাপাশি সক্রিয় ছিলেন কমল দাশগুপ্ত, শচীন দেববর্মণ, মৃণালকান্তি ঘোষ, কে মল্লিক, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন রায়, গিরিন চক্রবর্তী, বরদা গুপ্ত, বীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, জগন্ময় মিত্র, জগৎ ঘটক, নিতাই ঘটক, রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সত্যেশ্বর মুখোপাধ্যায়সহ অসংখ্য শিল্পী। শিল্পী কমল দাশগুপ্ত, ফিরোজা বেগম ও আববাসউদ্দীন পরে ঢাকায় চলে গেলেও নজরুল-গানের প্রচারে ছিলেন বিরামহীন।

এছাড়া নজরুলের গানে যাঁরা সুর দিয়েছিলেন কবির অনুমোদিত সেইসব সুরকারের মধ্যে নিতাই ঘটক, চিত্ত রায়, গিরিন চক্রবর্তী, ধীরেন দাস, কে মল্লিক, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়, দুর্গা সেন, সুরেশ চক্রবর্তী, জগন্ময় মিত্র, বিজনবালা ঘোষ, তুলসী লাহিড়ী, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞান দত্ত, মৃণালকান্তি ঘোষ, রাইচাঁদ বড়াল, হিমাংশু দত্ত, অনিল বাগচী, গোপেন মল্লিক, সত্য চৌধুরী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজ মল্লিকসহ প্রায় সকলেই দেশভাগের পরে পশ্চিমবঙ্গেই নজরুল-গানের চর্চা ও প্রসারের কাজে শিক্ষক হিসেবে যুক্ত ছিলেন।

পরে ষাটের দশকে সুশীল চট্টোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ধীরেন বসু, পূরবী দত্ত, সরোজ দত্ত, অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়, অধীর বাগচী, নীতিশ দত্তরায়, অরুণ দত্ত, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিমান মুখোপাধ্যায়, অনুপকুমার ঘোষাল, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সুকুমার মিত্র, শঙ্করলাল মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লাসহ অন্তত অর্ধশতাধিক নবীন প্রতিভাধর শিল্পীর কণ্ঠে নজরুলের গান রেকর্ডে ও সিডিতে এবং অসংখ্য গানের অনুষ্ঠানে নিয়মিত পরিবেশিত হয়ে এসেছে। সেগুলো আজো জনপ্রিয়।

কবির প্রয়াণের আগেই নজরুলের অসংখ্য গানের স্বরলিপিও তৈরি করেছেন পশ্চিমবঙ্গে কবির সহযোগী শিল্পীরা। এঁরা মূলত গ্রামোফোনে কবির সহযোগী ও আস্থাভাজন ছিলেন।

কিন্তু ২০১৩ সালেও কেউ কেউ লিখেছেন – ১) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নজরুল গবেষণা ও প্রকাশনা একেবারে নেই বলা চলে। ২) কলকাতায় গড়ে ওঠেনি কোনো নজরুল চর্চা কেন্দ্র। ৩) নজরুল একাডেমী (চুরুলিয়া) ১৯৮০ সাল থেকে নজরুল পদক প্রবর্তন করেছে। সম্ভবত এ-বিষয়ে ভালো করে খোঁজখবর না নেওয়ার ফলে এই বিভ্রান্তিমূলক তথ্য তাঁদের প্রকাশিত রচনায় স্থান পেয়েছে। সামান্য সতর্ক হলেই এই বিভ্রান্তির দায় এড়ানো যেত।

সকলের জ্ঞাতার্থে জানাই, শতবর্ষে পশ্চিমবঙ্গের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল রচনা স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত পাঠ্যসূচিতে স্থান পেয়ে এসেছে।

নজরুলের গান বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগে পৃথক বিষয় হিসেবে গৃহীত এবং বহু ছাত্রছাত্রী নজরুল প্রতিভার বিভিন্ন দিক নিয়ে অন্তত পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং আজো একাধিক গবেষক নানা স্থানে গবেষণারত। নজরুলের নামাঙ্কিত প্রেক্ষাগৃহও স্থাপিত হয়েছে বহু জায়গায়। এছাড়া সম্প্রতি পশ্চিমবাংলায় সরকারি উদ্যোগে গঠিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ কাজী নজরুল আকাদেমি (২০১১)। কলকাতায় রাজারহাটে নির্মিত হচ্ছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আকাদেমির নিজস্ব বিশাল ভবন ‘নজরুল তীর্থ’। প্রায় চার একর জমির ওপর ছয়টি লেনযুক্ত রাজপথের পাশে একদিকে গড়ে উঠেছে নজরুলের নামাঙ্কিত এই আকাদেমি, যেখানে তিনটি প্রেক্ষাগৃহসহ গবেষণাকক্ষ, অতিথিনিবাস, লাইব্রেরি, সংগ্রহশালা, বিশ্বের নানাপ্রান্ত থেকে আগত নজরুল গবেষক ও অনুরাগীদের সেখানে গেলে থাকার ব্যবস্থা। নিয়মিত সেখানে নজরুলবিষয়ক ওয়ার্কশপ, আলোচনা সভা, সংগীতের আসর, দেশ-বিদেশে নজরুল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ ও ভাববিনিময় ইত্যাদি ব্যবস্থা হওয়ার কথা। ২০১৫ সালে সেখানে নজরুল তীর্থ উন্মোচনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছে। সরকারি স্তরে আগেই পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি কবির জন্মশতবর্ষ থেকেই নজরুল গবেষক ও নজরুলবিষয়ক অবদানের জন্যে নজরুল পুরস্কার প্রবর্তন করেছেন। এর আগে ১৯৮০ সাল থেকেই চুরুলিয়ার নজরুল অ্যাকাডেমি নিয়মিত ভারত ও বাংলাদেশের নজরুল গবেষক ও গায়ক বা শিল্পীদের নজরুল পুরস্কার (পদক নয়) প্রদান করে চলেছে। কবিপক্ষে গত চল্লিশ বছর ধরেই কবিতীর্থ চুরুলিয়ায় প্রমীলা মঞ্চে প্রতিবছর নজরুলের সাহিত্য, কবিতা ও গান নিয়ে সেমিনার, সংগীত ও নৃত্য, গীতিনাট্য, নাটক পরিবেশিত হয়ে থাকে। সেইসঙ্গে গ্রাম্য মেলা, কবিগান, লেটোগান সেখানে শোনার সৌভাগ্য হয়। আনা হচ্ছে নিয়মিত বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত বক্তা, গবেষক ও শিল্পীদেরও। পশ্চিমবঙ্গে নজরুলকে স্মরণে রেখে পঞ্চাশের দশকেই গঠিত হয় কবির জন্মভিটেয় চুরুলিয়ায় ১) নজরুল একাডেমী (১৯৫৮); ২) পশ্চিমবঙ্গ নজরুল জন্মজয়ন্তী কমিটি (১৯৬২) (সভাপতি : ব্রজকান্ত গুহ); ৩) পশ্চিমবঙ্গ নজরুল অ্যাকাডেমির (১৯৬৬) (উদ্বোধক মুজফ্ফর আহমদ); ৪) অগ্নিবীণা (সম্পাদক : কাজী সব্যসাচী); ৫) নজরুল ফাউন্ডেশন (রমলা চক্রবর্তী); ৬) নজরুল চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র বরদা গুপ্ত ৭) নব অগ্নিবীণা (সভাপতি : কল্পতরু সেনগুপ্ত); ৮) রূপমঞ্জরী (সভাপতি : ধীরেন বসু); ৯) নজরুল ফাউন্ডেশন (সম্পাদক : মজহারুল ইসলাম); ১০) নজরুল সংস্কৃতি পরিষদ (১৯৯৯) (সভাপতি : ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়)সহ একাধিক নজরুলচর্চা কেন্দ্র যা আজো সক্রিয়।

পশ্চিমবঙ্গে এইসব কর্মকান্ড ও নজরুলচর্চার সুফল দুশো পঞ্চাশটি নজরুলবিষয়ক গ্রন্থের প্রকাশ। রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে সকল নজরুলবিষয়ক গবেষণাকর্মের জন্য একাধিক পিএইচ.ডিপ্রাপ্ত গবেষকদল। রয়েছে অসংখ্য নজরুলগীতির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

নানা কারণে পশ্চিমবঙ্গ সরকারি অর্থানুকূল্য থেকে বঞ্চিত ছিল। ফলে শতবর্ষে বিলম্বে হলেও প্রকাশিত হয়েছে সাত খন্ডে কাজী নজরুল রচনাসমগ্র, যাকে বলা হয়ে থাকে সর্বাধুনিক রচনাসমগ্র। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ৯৫ শতাংশ গ্রন্থই প্রকাশিত হয়েছে বেসরকারি প্রকাশনার মাধ্যমে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে সৌভাগ্যবান। ফলে জাতীয় কবি কাজী নজরুলের চর্চা ও জিজ্ঞাসা সেখানে অন্তহীন। সেই গৌরব সেখানে নজরুল-অনুরাগী সামজের অবশ্যই প্রাপ্য।

বিশ্বমানবতার কবি নজরুল এদেশে জন্মেছেন বলে যেমন এপার বাংলার নন, তেমনি সেখানে যে-ভূমিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি, শুধু সেখানকারও নন। তিনি সমগ্র মানবজাতির আত্মীয়, আপনজন। কোনো সংকীর্ণতার তিনি শিকার ছিলেন না। তাই তাঁর চর্চা ও অনুসন্ধান সর্বত্রই হওয়া উচিত। ভালোবাসার তালিকায় কম-বেশির হিসাব-নিকাশ নাইবা রইল! বরং চলুক নিরন্তর ভাববিনিময় আর কবির বিষয়ে নিত্যনব পারস্পরিক সাফল্য ও জিজ্ঞাসার অন্তহীন ভাবনাবিনিময়। অভিমান বা অভিযোগ সেই ভালোবাসার কাননে নেহায়েতই অনুপ্রবেশকারী মাত্র।

পরিশেষে কবির গানের কথায় শুধু বলতে হয় –

একটি কথা কয়ে যেয়ো, একটি নমস্কার,

সেই কথাটি গানের সুরে গাইব বারেবার

হাত ধরে মোর বন্ধু ভুলো একটু মনের ভুল \

(গানের মালা, কাজী নজরুল ইসলাম, আশ্বিন ১৩৪১)

বিদ্রোহী কবিতায় ব্যবহৃত বিভিন্ন পৌরানিক রূপকসমুহের ব্যাখ্যা



কথিত আছে নজরুল নাকি একরাতেই তার বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে শেষ করেছিলেন! বচনে, চয়নে আর বক্তব্যে অসাধারন এক কবিতা। অনেকেই বলেন ওয়াল্ট হুইটম্যানের ‘সং অফ মাইসেলফ’ কবিতা থেকেই তিনি এই কবিতা লেখার অনুপ্রেরনা পেয়েছিলেন। অনেকে আবার মনে করেন ১ম বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশ-ইন্ডিয়ান আর্মির ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের কোয়ার্টারমাস্টার হাবিলদার হিসেবে চাকুরীর সুবাদে দেশি বিদেশি সৈন্যদের সাথে মেলামেশার প্রেক্ষিতেই গ্রীক আর ইন্ডিয়ান মিথের প্রতি তার গভীর অনুরাগ গড়ে ওঠে।

এই কবিতার ছত্রে ছত্রে পৌরানিক রুপকের ব্যবহার এতোটাই যথার্থ যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। রূপকের প্রয়োগ দেখে যে কেউ আঁচ করতে পারবেন, গ্রীক আর ইন্ডিয়ান মিথের ওপর কবির কতোটা দখল ছিল। অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ব্যবহৃত রূপকগুলোর নেপথ্যের গল্প নিয়ে লিখব। সেই সুত্রেই এই প্রয়াস।বলবীর
বলউন্নতমমশির!
শিরনেহারীআমারিনতশিরওইশিখরহিমাদ্রীর!

বলবীর
বলমহাবিশ্বেরমহাকাশফাড়িচন্দ্রসূর্য্যগ্রহতারাছাড়িভূলোকদ্যূলোকগোলোকভেদিয়াখোদারআসনআরশছেদিয়া,
উঠিয়াছিচিরবিস্ময়আমিবিশ্ববিধাতৃর!
মমললাটেরুদ্রভগবানজ্বলেরাজরাজটীকাদীপ্তজয়শ্রীর!

(ভূলোক মানে পৃথিবী, দ্যুলোক মানে স্বর্গ, আর গোলক মানে বিষ্ণুলোক অথবা স্বর্গে বিষ্ণু বা কৃষ্ণের বাসস্হান। কৃষ্ণ-রাধার বৃন্দাবন এখানেই অবস্থিত। ঋগ্বেদে রুদ্র বজ্রের দেবতা, গ্রীক মিথের ‘থর’ এর মত। ক্ষেপে গেলে বজ্র ছুড়ে মারেন। ইনি ব্রহ্মার পুত্র। তার ক্রোধে নেমে আসে ধ্বংস আর মহামারী।)বলবীরআমিচিরউন্নতশির!
আমিচিরদুর্দম, দূর্বিনীত, নৃশংস,
মহাপ্রলয়েরআমিনটরাজ, আমিসাইক্লোন, আমিধ্বংস!
আমিমহাভয়, আমিঅভিশাপপৃথ্বীর,
আমিদূর্বার, আমিভেঙেকরিসবচুরমার!

(মহাদেব মহাপ্রলয়ের সময় তান্ডব নৃত্য নেচেছিলেন, গজাসুর ও কালাসুরকে বধ করেও তিনি তান্ডব নৃত্য নেচেছিলেন। এই তান্ডব নৃত্যকলার উদ্ভাবক হিসেবে তাকে নটরাজ ডাকা হয়। পৃথু ছিলেন অত্রি বংশের অত্যাচারী রাজা বেন এর পুত্র। রাজা বেন এর মৃত্যুর পর তার ডান বাহু থেকে পৃথুর জন্ম। প্রজা কল্যানার্থে পৃথু পৃথিবীকে বশ করেন। তার রাজত্বকে বলা হয় পৃথু।)

আমিঅনিয়মউচ্ছৃঙ্খল,
আমিদলেযাইযতবন্ধন, যতনিয়মকানুনশৃঙ্খল!
আমিমানিনাকোকোনআইন,
আমিভরাতরীকরিভরাডুবি, আমিটর্পেডো, আমিভীমভাসমানমাইন!
আমিধূর্জটী, আমিএলোকেশেঝড়অকালবৈশাখীরআমিবিদ্রোহী, আমিবিদ্রোহীসুতবিশ্ববিধাতৃর!
বলবীরচিরউন্নতমমশির!

(ভীম পাঁচ পান্ডবদের একজন। কুন্তির গর্ভে এবং বায়ুর ঔরসে এর জন্ম। দুর্যোধন তাকে হত্যার জন্য তার খাবারে বিষ মিশিয়ে অজ্ঞান করে পানিতে ফেলে দেন। পানিতে নাগরাজ বাসুকীর কৃপায় ভীম বেঁচে যান এবং আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসেন। কবি ‘ভাসমান মাইনে’র সাথে ভীম বিশেষন সম্ভবত একারনের এনেছেন। ‘ধূর’ শব্দের অর্থ জটাভার বা ত্রিলোকের চিন্তাভার। শিব তার মাথায় জটাভার ধারণ করেন
অথবা ত্রিলোকের চিন্তাভার ধারণ ও বহন করেন। এসকল ভার বহন ও ধারণের কারণে তারই নাম ধূর্জটি।)



আমিঝঞ্ঝা, আমিঘূর্ণি,
আমিপথসম্মুখেযাহাপাইযাইচূর্ণি।আমিনৃত্যপাগলছন্দ,
আমিআপনারতালেনেচেযাই, আমিমুক্তজীবনানন্দ।আমিহাম্বীর, আমিছায়ানট, আমিহিন্দোল,
আমিচলচঞ্চল, ঠমকিছমকিপথেযেতেযেতেচকিতেচমকিফিংদিয়াদেইতিনদোলআমিচপোলাচপোলহিন্দোল।আমিতাইকরিভাইযখনচাহেমনযা,
করিশত্রুরসাথেগলাগলি, ধরিমৃত্যুরসাথেপাঞ্জা,
আমিউন্মাদ, আমিঝঞ্ঝা!
আমিমহামারী, আমিভীতিধরীত্রির;
আমিশাসনত্রাসন, সংহারআমিউষ্ণচিরঅধীর।বলবীরআমিচিরউন্নতশির!

(হাম্বীর, হিন্দোল হল সান্ধ্য রাগিনী বিশেষ। )

আমিচিরদূরন্তদুর্মদআমিদূর্দমমমপ্রাণেরপেয়ালাহর্দম্হ্যায়হর্দম্ভরপুর্মদ।আমিহোমশিখা, আমিসাগ্নিকজমদগ্নি,
আমিযজ্ঞ, আমিপুরোহিত, আমিঅগ্নি।আমিসৃষ্টি, আমিধ্বংস, আমিলোকালয়, আমিশ্মশান,
আমিঅবসান, নিশাবসান।আমিঈন্দ্রাণীসুতহাতেচাঁদভালেসূর্যমমএকহাতেবাঁকাবাঁশেরবাঁশরীআরহাতেরণতূর্য;
আমিকৃষ্ণকন্ঠ, মন্থনবিষপিয়াব্যথাবারিধির।আমিব্যোমকেশ, ধরিবন্ধনহারাধারাগঙ্গোত্রীর।বলবীরচিরউন্নতমমশির!

(সাগ্নিক মানে যে আগুন সবসময় জ্বলে। জমদগ্নি হলেন চার প্রকার বেদেই পন্ডিত বৈদিক ঋষি। রেনুকা ছিলেন তার স্ত্রী। একদিন গোসল করতে গিয়ে রাজা চিত্ররথকে তার স্ত্রীদের সাথে জল-ক্রীড়া করতে দেখে রেনুকা কামোত্তেজিত হয়ে বাড়ি ফেরেন। স্ত্রীর চেহারা দেখে জমদগ্নি ভুল সন্দেহ করে বসেন এবং রেনুকাকে হত্যা করতে তার পুত্রদের নির্দেশ দেন। একে একে চার পুত্র অপারগতা প্রকাশ করলে ক্রোধান্ধ জমদগ্নি তাদের সবাইকে অভিশাপ দিয়ে পাথর করে দেন।

ইন্দ্রানী ইন্দ্রের স্ত্রী এবং তার ‘সুত’ বা পুত্রের নাম জয়ন্ত। রমায়নে ইনি বিক্রমের সাথে রাক্ষসসেনাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন।

একদা সমুদ্র মন্থনের ফলে সমুদ্রের তলা থেকে ভয়ঙ্কর বিষ উঠে আসে, যাতে পৃথিবী ধংসের উপক্রম হয়। ব্রহ্মার অনুরোধে শিব বা মহাদেব সেই বিষ শুষে নেন। বিষের প্রভাবে তার গলা নীল হয়ে যায়। তাই তাকে ডাকা হয় নীলকণ্ঠ বা কৃষ্ণ কন্ঠ।

ব্যোমকেশ মানেও শিব। স্বর্গ থেকে গঙ্গায় অবতরন কালে তার জটা আকাশময় ছড়িয়ে গিয়েছিল বলে এই নাম। অযোধ্যার রাজা সগরের অশ্বমেধযজ্ঞের অশ্ব চুরি করেছিলেন ইন্দ্র। সেই অশ্ব খুজতে খুজতে সগরের ৬০,০০০ সন্তান পাতালে কপিলের আশ্রমে গিয়ে তা খুঁজে পায়। কপিল মুনিকে ঘোড়াচোর ভাবার কারনে কপিল মুনি তাদের পুড়িয়ে ছাই করে দেন। একমাত্র গঙ্গার জলের ছোয়া পেলে এরা আবার বেঁচে উঠবেন। কিন্তু গঙ্গা তো থাকেন স্বর্গে, শুরু হল তাকে পৃথিবীতে আনার উপাসনা। সগর ব্যর্থ, অংশুমান ব্যর্থ, দীলিপও ব্যর্থ। অবশেষে ৪র্থ পুরুষ ভগীরথ ব্রহ্মাকে তুস্ট করলেন। অতঃপর শিবের সহায়তায় গঙ্গাকে পৃথিবীতে আনা হয়েছিল।)

আমিসন্ন্যাসী, সুরসৈনিক,
আমিযুবরাজ, মমরাজবেশম্লানগৈরিক।আমিবেদুইন, আমিচেঙ্গিস,
আমিআপনারেছাড়াকরিনাকাহারেকূর্ণিশআমিবজ্র, আমিঈষাণবিষানেওঙ্কার,
আমিইস্রাফিলেরশৃঙ্গারমহাহুঙ্কার,
আমিপিনাকপাণিরডমরুত্রিশুল, ধর্মরাজেরদন্ড,
আমিচক্রমহাশঙ্খ, আমিপ্রণবনাদপ্রচন্ড!
আমিক্ষ্যাপাদুর্বাসা, বিশ্বামিত্রশিষ্য,
আমিদাবানলদাহ, দহনকরিববিশ্ব।আমিপ্রাণখোলাহাসিউল্লাস, –আমিসৃষ্টিবৈরীমহাত্রাসআমিমহাপ্রলয়েরদ্বাদশরবিররাহুগ্রাস!

(চেঙ্গিশ খান ছিলেন মঙ্গোলিয়ান সম্রাট এবং দুর্ধর্ষ সমরনায়ক। যুবক চেঙ্গিসের স্ত্রীকে অপহরন করে নিয়ে যায় আরেক গোত্র প্রধান। চেঙ্গিস খান তার নিজ গোত্রকে পুনর্গঠিত করে অপহরনকারী গোত্রকে নৃশংস ভাবে পরাস্ত করে স্ত্রীকে উদ্ধার করেন। এরপর অন্যান্য মোঙ্গল গোত্রদের একীভুত করে অর্ধেক বিশ্ব জয় করেন।

ইসলাম ধর্মমতে কেয়ামত বা মহাপ্রলয় শুরুর আগে ইস্রাফিল নাম্মী ফেরেস্তা শৃঙ্গার বাজাবেন।

পিনাক-পানি শিবের অন্য নাম। পিনাক নামে তার ব্যবহৃত সরঞ্জাম যা যুদ্ধে ধনুক হিসেবে তিনি ব্যবহার করতেন, অন্যসময় বাদ্যযন্ত্র হিসেবে।

ধর্মরাজ যমের অন্যনাম, যিনি নরকের অধীশ্বর দেবতা এবং দেবগনের মধ্যে সবচে পুন্যবান। দন্ডের সাহায্যে ইনি জীবের প্রান সংহার করেন।

দুর্বাসা ক্ষ্যাপাটে এক মুনি।এমন ক্ষ্যাপা যে নিজের স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন যে তার শত ত্রুটি তিনি মার্জনা করবেন, এবং ঠিক ১০১ তম বার শাপ দিয়ে পুরিয়ে ছাই করে ফেলেছিলেন।এর শাপে ইন্দ্র শ্রীভ্রষ্ঠ হন, শকুন্তলা দুষ্মন্ত কর্তৃক পরিত্যাক্তা হন, মানে পান থেকে চুন খসলেই তিনি রেগে গিয়ে শাপশাপান্ত দিয়ে অস্থির করে ফেলতেন।

বিশ্বামিত্র ছিলেন ব্রহ্মার্ষি, যিনি ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মেও তপস্যাবলে ব্রাহ্মন হয়েছিলেন। তার অধ্যবসায় দৃষ্টান্তমূলক।

রাহু এক দানব, যিনি দেবতা সেজে কৃষ্ণের দেয়া সুধা পান করার সময় চন্দ্র আর সুর্য্যের কারনে ধরা পরে যান। ক্রুদ্ধ বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্রের আঘাতে এর মাথা কেটে ফেললেও স্বর্গসুধা পানের কারনে ততক্ষনে সে অমরত্ব লাভ করেছে। সেই থেকে মাথার নাম রাহুই থাকল, আর দেহের নাম হল কেতু। রাহু চান্স পেলেই চন্দ্র সুর্য্যকে গিলে ফেলে গ্রহন ঘটায়।)

আমিকভুপ্রশান্ত, –কভুঅশান্তদারুণস্বেচ্ছাচারী,
আমিঅরুণখুনেরতরুণ, আমিবিধিরদর্পহারী!
আমিপ্রভঞ্জনেরউচ্ছাস, আমিবারিধিরমহাকল্লোল,
আমিউজ্জ্বল, আমিপ্রোজ্জ্বল,
আমিউচ্ছলজলছলছল, চলঊর্মিরহিন্দোলদোল!-
আমিবন্ধনহারাকুমারীরবেনী, তন্বীনয়নেবহ্নি,
আমিষোড়শীরহৃদিসরসিজপ্রেমউদ্দাম, আমিধন্যি!
আমিউন্মন, মনউদাসীর,
আমিবিধবারবুকেক্রন্দনশ্বাস, হাহুতাশআমিহুতাশীর।আমিবঞ্চিতব্যথাপথবাসীচিরগৃহহারাযতপথিকের,
আমিঅবমানিতেরমরমবেদনা, বিষজ্বালা, প্রিয়লাঞ্ছিতবুকেগতিফেরআমিঅভিমানীচিরক্ষূব্ধহিয়ারকাতরতা, ব্যাথাসূনিবিড়,
চিতচুম্বনচোরকম্পনআমিথরথরথরপ্রথমপরশকুমারীর!
আমিগোপনপ্রিয়ারচকিতচাহনি, ছলকরেদেখাঅনুখন,
আমিচপলমেয়েরভালোবাসা, তাঁরকাঁকণচুড়িরকনকন।আমিচিরশিশু, চিরকিশোর,
আমিযৌবনভীতুপল্লীবালারআঁচরকাঁচুলিনিচোর!
আমিউত্তরবায়ুমলয়অনিলউদাসপূরবীহাওয়া,
আমিপথিককবিরগভীররাগিণী, বেণুবীণেগানগাওয়া।আমিআকুলনিদাঘতিয়াসা, আমিরৌদ্ররুদ্ররবিআমিমরুনির্ঝরঝরঝর, আমিশ্যামলিমাছায়াছবি!
আমিতুরীয়ানন্দেছুটেচলি, কিউন্মাদআমিউন্মাদ!
আমিসহসাআমারেচিনেছি, আমারখুলিয়াগিয়াছেসববাঁধ!
আমিউত্থান, আমিপতন, আমিঅচেতনচিতেচেতন,
আমিবিশ্বতোরণেবৈজয়ন্তী, মানববিজয়কেতন।ছুটিঝড়েরমতনকরতালীদিয়াস্বর্গমর্ত্যকরতলে,
তাজীবোর্রাক্; আরউচ্চৈঃশ্রবাবাহনআমারহিম্মতহ্রেষাহেঁকেচলে!
আমিবসুধাবক্ষেআগ্নেয়াদ্রী, বাড়ববহ্নি, কালানল,
আমিপাতালেমাতাল, অগ্নিপাথারকলরোলকলকোলাহল!
আমিতড়িতেচড়িয়া, উড়েচলিজোড়তুড়িদিয়াদিয়ালম্ফ,
আমিত্রাসসঞ্চারিভুবনেসহসা, সঞ্চারিভূমিকম্প।ধরিবাসুকিরফণাজাপটিধরিস্বর্গীয়দূতজিব্রাইলেরআগুনেরপাখাসাপটি।

(বোররাক দ্রুতগতির স্বর্গীয় বাহন, যাতে করে মহানবী (সাঃ) মেরাজে গিয়েছিলেন। উচ্চৈঃশ্রবা ইন্দ্রের বাহন, যা সমুদ্রমন্থনের সময় জন্ম নেয় এবং অশ্বশ্রেষ্ঠ বলে পরিগনিত।

বাসুকি নাগরাজ, ইনি কশ্যপ ও কদ্রুর পুত্র এবং মনসার ভাই।

জিব্রাইল একজন ফেরেস্তা যিনি স্বর্গীয় দুত হিসেবে কাজ করেন।)

আমিদেবশিশু, আমিচঞ্চল,
আমিধৃষ্ট, আমিদাঁতদিয়াছিঁড়িবিশ্বমায়েরঅঞ্চল!
আমিঅর্ফিয়াসেরবাঁশরী,
মহাসিন্ধুউতলাঘুম্ঘুম্ঘুম্চুমুদিয়েকরিনিখিলবিশ্বেনিঝ্ঝুমমমবাঁশরীরতানেপাশরিআমিশ্যামেরহাতেরবাঁশরী।আমিরুষেউঠেযবেছুটিমহাকাশছাপিয়া,
ভয়েসপ্তনরকহাবিয়াদোযখনিভেনিভেযায়কাঁপিয়া!
আমিবিদ্রোহবাহীনিখিলঅখিলব্যাপিয়া! আমিশ্রাবণপ্লাবনবন্যা,
কভুধরনীরেকরিবরণীয়া, কভুবিপুলধ্বংসধন্যা
আমিছিনিয়াআনিববিষ্ণুবক্ষহইতেযুগলকন্যা!
আমিঅন্যায়, আমিউল্কা, আমিশনি,
আমিধূমকেতুজ্বালা, বিষধরকালফণী!
আমিছিন্নমস্তাচন্ডী, আমিরণদাসর্বনাশী,
আমিজাহান্নামেরআগুনেবসিয়াহাসিপুষ্পেরহাসি!

(অর্ফিয়াস বা ওর্ফেউস একটি গ্রিক পৌরাণিক চরিত্র, যিনি বাদ্যযন্ত্রের সুরের মুর্ছনায় পাথরেও প্রান সঞ্চার করতে পারতেন।

শ্যাম মানে কৃষ্ণ, ইনিও তার বাঁশি বাজিয়ে মুগ্ধ করতেন।

যুগল কন্যা সমুদ্র মন্থনের সময় উত্থিত কৌস্তভ মনি যা বিষ্ণু ও কৃষ্ণ বক্ষে ধারন করতেন।

ছিন্নমস্তা দশ মহাবিদ্যা বা দশ প্রকার শক্তির রুপের একটি। চন্ডী অসুর বধের সময় দুর্গার এক ভীষন রূপ।)


আমিমৃন্ময়, আমিচিন্ময়,
আমিঅজরঅমরঅক্ষয়, আমিঅব্যয়!
আমিমানবদানবদেবতারভয়,
বিশ্বেরআমিচিরদুর্জয়,
জগদীশ্বরঈশ্বরআমিপুরুষোত্তমসত্য,
আমিতাথিয়াতাথিয়ামাথিয়াফিরিস্বর্গপাতালমর্ত্য!
আমিউন্মাদ, আমিউন্মাদ!!
আমিসহসাআমারেচিনেছি, আজিকেআমারখুলিয়াগিয়াছেসববাঁধ!! আমিপরশুরামেরকঠোরকুঠার,
নিঃক্ষত্রিয়করিববিশ্ব, আনিবশান্তিশান্তউদার!
আমিহলবলরামস্কন্ধে,
আমিউপাড়িফেলিবঅধীনবিশ্বঅবহেলেনবসৃষ্টিরমহানন্দে।মহাবিদ্রোহীরণক্লান্তআমিসেইদিনহবশান্ত,
যবেউৎপীড়িতেরক্রন্দনরোল, আকাশেবাতাসেধ্বনিবেনা,
অত্যাচারীরখড়গকৃপাণভীমরণভূমেরণিবেনা
বিদ্রোহীরণক্লান্তআমিআমিসেইদিনহবশান্ত!
আমিবিদ্রোহীভৃগু, ভগবানবুকেএঁকেদিইপদচিহ্নআমিস্রষ্টাসুদন, শোকতাপহানাখেয়ালীবিধিরবক্ষকরিবভিন্নআমিবিদ্রোহীভৃগু, ভগবানবুকেএঁকেদিবপদচিহ্নআমিখেয়ালীবিধিরবক্ষকরিবভিন্নআমিচিরবিদ্রোহীবীরবিশ্বছাড়ায়েউঠিয়াছিএকাচিরউন্নতশির!



(পরশুরাম জমদগ্নি ও রেনুকার পঞ্চম পুত্র।কুঠার ছিল তার প্রিয় অস্ত্র। একবার ক্ষত্রিয়রাজ কার্তবীর্য জমদগ্নির আশ্রমে এসে আশোভন আচরন করেন। পরশুরাম তখন আশ্রমে উপস্থিত ছিলেন না। ফিরে এসে ঘটনা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি কার্তবীর্যকে ধাওয়া করেন, এবং পরে হত্যা করেন। এতে কার্তবীর্যের পুত্ররা জমদগ্নিকে হত্যা করে পিতৃহত্যার শোধ নেন। এবার পরশুরাম পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে সারা পৃথিবী থেকে ক্ষত্রিয়দের নিঃশ্চিহ্ন করতে পন করেন এবং পরপর একুশ বার পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করে তবে থামেন।

বলরাম ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের বড় ভাই। গদা যুদ্ধে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হলেও তার প্রিয় অস্ত্র ছিল হল বা লাঙ্গল, তাই তাকে হলধরও বলে। কুরুক্ষত্রের যুদ্ধে ইনি নিরপেক্ষ থাকলেও, কংস হত্যায় তিনি কৃষ্ণ কে সহায়তা করেছিলেন। দুর্যোধন ও ভীমের গদাযুদ্ধে ভীম অন্যায়ভাবে দুর্যোধনের উরু ভেঙ্গে দিলে বলরাম যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে পান্ডবদের আক্রমন করতে উদ্যত হলে কৃষ্ণ তাকে শান্ত করেছিলেন।

ভৃগু প্রাচীন সপ্তর্ষিদের অন্যতম। একবার মুনিঋষিরা ব্রহ্মা, শিব আর বিষ্ণুর মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা মিমাংশার জন্য ভৃগুর দ্বারস্থ হন। ভৃগু প্রথমে ব্রহ্মা ও পরে শিবের সাথে দেখা করেন এবং উদ্দেশ্যমুলকভাবে তাদের ক্ষেপিয়ে দেন। সবশেষে তিনি বিষ্ণুর সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখেন বিষ্ণু ঘুমাচ্ছেন। তখন তাকে জাগাতে তিনি তার বুকে লাথি মারেন। ঘুম ভেঙ্গে বিষ্ণু ভৃগুর এই ধৃষ্টতায় রাগান্বিত না হয়ে বিনয় প্রদর্শন করতে থাকলে, ভৃগু বিষ্ণুকে শ্রেষ্ঠ বলে মত দেন। )



যে ঘটনা কবি নজরুলকে বদলে দিল, কবি কাঁদলেন, এরপর থেকে বিষণ্ণ হয়ে গেলেন..

কবি নজরুলের প্রথম ছেলেটির নাম ছিল বুলবুল।
কবি তার এই ছেলেটিকে খুব ভালবাসতেন, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। বাবা হিসেবে মনের মত করে তিনি তাকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তার জীবন ও যৌবন সাজাতে চেয়েছিলেন। বুলবুল এর গলাও ছিল অসাধারণ মিষ্টি। কবির সাথে যারা আড্ডা দিতে আসতেন, তারাও তাকে আদর করতেন, তার মুখের কথা শুরে অবাক হতেন।
শুধু কি তাই, কবি যখন হারমোনিয়াম হাতে নিয়ে কোন সুর বাজাতেন, ছোট্ট ছেলে বুলবুল সবাইকে তাক লাগিয়ে বলে দিত, আব্বু এখন এই গানটি করবেন, এ বাজনা এ গানেরই। তার গলায় গান শুনে অবাক হয়েছিলেন তৎকালে কবির বন্ধুবান্ধবরা।

কবি যেখানে যেতেন, এই ছোট খোকাকে সাথে নিয়ে যেতেন। বুলবুলকে নিয়ে কেটে যেত তার হাসি আনন্দে ভরা উচ্ছল সময়গুলো। বাধা বন্ধনহীন কবির ছন্নছাড়া জীবন ধীরে ধীরে সুশৃঙ্খল হয়ে উঠছিল বুলবুলকে ঘিরে।

জন্মের পর থেকে দুঃখ যার নিত্য সঙ্গী, সেই দুখুমিয়া কবি নজরুলের কপালে এ সুখ আনন্দ বেশীদিন সইলো না। অল্প বয়সে কবির ছেলেটি অসুখে ভুগে চলে গেল পরপারে।

আদরের প্রথম সন্তান ছোট খোকা বুলবুলের এ মৃত্যু কবিকে ভেঙে চুরমার করে দিল। জীবনের প্রথম স্বপ্নসৌধ অবেলায় টুকরো টুকরো হয়ে গেল সদা হাস্যপ্রাণ কবি নজরুলের। মাত্র কয়েক লাইন লিখে কবির দুঃখ বেদনা আর মুষড়ে পড়ার কথা এখানে বুঝানো অসম্ভব।

কাঁদতে কাঁদতে কবির চোখদুটো ফুলে গিয়েছিল, নাওয়া খাওয়া ভুলে এমন ”ঞ্চল কাজী নজরুল একেবারে নীরব হয়ে গেলেন, কতখানি শোকে বিদ্রোহী কবি পাথর হয়ে চুপচাপ হয়ে যেতে পারেন, তা অনুমান করা হয়তো কিছুটা সম্ভব।
বুলবুলের সব খেলনা, জামা কাপড় কবি পরম আদরে সাজিয়ে রেখেছিলেন। তাকে সান্তনা জানিয়ে তার বন্ধুরা যেসব চিঠিপত্র পাঠাতেন, সেসব পড়ে কবি জোরে জোরে কেঁদে বুক ভাসাতেন নয়নের জলে।

বুলবুলের চিকিৎসায় তার অনেক টাকাও খরচ হয়েছিল, কাজেই মৃত্যুশোকের সাথে এবার যোগ হল অর্থকষ্ট। ভরাক্রান্ত কবির কাছে এ দিনগুলো ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছিল।

তার জীবনীকারদের কেউ কেউ লিখেছেন, প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পর থেকে কবির জীবনে একটি ভাবান্তর আসে, কবি তখন সবার অলক্ষ্যে আধ্যাত্মিক জীবনের দিকে আসক্ত হয়ে পড়েন, তার রচনা ও লেখার স্রোত ধীর হয়ে আসে, এভাবে চলতে থাকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত, এরপর তো তিনি চিরতরে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।

পঞ্চানন ঘোষাল তখন কলকাতার তরুণ পুলিশ অফিসার। কাজী নজরুলকে তিনি ভালোবাসেন এবং মাঝে মাঝে তার সাথে গল্প করেন। একবার কবির বাসায় তল্লাশীর হুকুম এল উপর থেকে। এ বেচারাকে দায়িত্ব দেয়া হল সে দলে থাকার। গোয়েন্দারা তাকে নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল কবির ঘরের। কাজী নজরুল দরজা খুলে দিলেন এবং সঙ্গত কারণে এই তরুণ অফিসার এবং কবি দুজনই পরস্পরকে না চেনার ভান করে রইলেন। গোয়েন্দা পুলিশের দল কবির ঘরে সবকিছু তছনছ করে তল্লাশী চালাচ্ছে, কবিও তাদেরকে যথাসম্ভব বাক্স খুলে খূলে দেখাচ্ছেন।

হঠাৎ ঘরের কোনে পরম যতেœ উঠিয়ে রাখা একটি বাক্সে নজর পড়ল তাদের। তারা সেটি খুলে দেখতে চাইল। কবি অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন, না না, ওটাতে হাত দিবেন না যেন।

কবির বিচলিত মুখভঙ্গি দেখে পুলিশদের সন্দেহ তীব্র হল। তাদের একজন সজোরে সেটি খুলতেই সেই বাক্সটি থেকে ঝরে পড়ল কিছূ খেলনা আর ছোট ছোট জামা কাপড়সহ বাচ্চাদের অন্যান্য সামগ্রী।

এভাবে সেগুলো আছড়ে মাটিতে পড়তে দেখে কবির দু চোখ পানিতে ভরে গেল। ঝরঝর করে তিনি কেঁদে দিলেন সবার সামনে। এমন সুকঠিন মুখখানা তার ব্যাথায় ও দুঃখে কালো হয়ে এল।

এ খেলনা ও ব্যবহার্য সামগ্রীগুলো ছিল কবির আদরের সন্তান এই ছোট বুলবুলের। তার মৃত্যুর পর এসব বুকে জড়িয়ে কবি সান্তনা খূঁজে পেতেন, আদর আর চুমো পৌঁছে দিতেন বুলবুলের গালে।

এ অফিসার তার এক লেখায় নিজেকে অত্যন্ত ব্যর্থ ও লজ্জিত উল্লেখ করে লিখেছেন, এরপর কত মানুষের কত ঘর সার্চ করেছি, কিন্তু সেদিনের মতো এমন কষ্ট আর কোথাও পাইনি।

নজরুল লিখলেন তার বুলবুলকে নিয়ে, আমার কাননের বুলবুলি উড়ে গেছে, যে দেশে গেছ তুমি- সে কি বুলবুলিস্তান ইরানের চেয়েও বেশী সুন্দর।’
আরেক জায়গায় লিখেছেন, আমি যখন আমার পথ খুঁজছি, তখন আমার প্রিয়তম পুত্রটি সেই পথের ইঙ্গিত দেখিয়ে আমার হাত পিছলে মৃত্যুর সাগরে হারিয়ে গেল। মৃত্যু এই প্রথম আমার কাছে ধর্মযাজকরূপে দেখা দিল, সেই মৃত্যুর পশ্চাতে আমার অন্তরাত্মা নিশিদিন ফিরতে লাগল…ধর্মরাজ আমার পুত্রকে শেষবার দেখিয়ে হেসে চলে গেলেন।’

এ সময় কবি প্রায়ই ধ্যানমগ্ন থাকতেন, নীরব হয়ে দিন কাটাতেন, এমনকি এ দুরন্ত কবি তার বন্ধুদেরকে, যাদেরকে নিয়ে দিনরাত ভুলে হাসি আড্ডায় মেতে থাকতেন, তাদেরকে একবার বলে ফেললেন, আমি এ ভারতের সর্বসেরা ধ্যানমগ্ন ব্যক্তি।

কবির জীবনে বুলবুলের মৃত্যুতে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা তিনি নির্বাক হওয়ার আগ পর্যন্ত আর ভুলতে পারেন নি। কবিতার আগুনে জ্বালাময়ী লেখায় আর ভরাট গলার টানে যে কবি পুরো বাংলাকে যাদুগ্রস্ত করে মোহময় করে রাখতেন, এমন বিদ্রোহী আর অশান্ত কবি নজরুলের মমতাময় মনের এমন প্রকাশ দেখে তার বন্ধুরাও নিশ্চুপ হয়ে থাকতেন।

বাংলা সংগীতে কবি কাজী নজরুল

বাল্যকাল থেকেই কবি নজরুল সংগীত রচনা করেন। সংগীত রচনার হাতে খড়ি বাল্যকাল থেকেই থেকেই তিনি পারদর্শিতা পরিচয় দেন । ১৯২০ সালে কবি নজরুলের আনুষ্ঠানিক সংগীত রচনা শুরু হয়। করাচি থেকে ফিরে এসেই তিনি কবিতা ও গানে মনোনিবেশ করেন। ১৯২০ সাল থেকেই ১৯৪২ সালে এ পর্যন্ত এ বছরের বেশিরভাগ সময় কাটে গান আর কবিতা লিখে। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ২৮০০ গান রচনা করেছেন এবং এর মধ্যে কুমিল্লা দৌলতপুওে ১২০টি গান ও ১৬০ কবিতা রচনা করেন ।

গানগুলো ২৩ প্রকার : এগুলো হলো নজরুলগীতি,জাগরণী,দেশাত্মবোধক, গজল,ভক্তিমূলক হাম-নাত, ভজন, কীর্তন,শ্যামা সংগীত,বাউল,কাব্যগীতি,ঋতু সংগীত, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, ধ্রুপদ,খেয়াল,হাসির গান ও শেখর । শুধু তাই নয় তিনি সংগীত শিক্ষকও ছিলেন। তৎকালীন সময়ের বিশেষজ্ঞ সাহেবের কাছ থেকে ঢাকায় এসে তিনি নজরুলসঙ্গীত শিল্পী ও তৈরি করেন কবি নজরুলের গান

আসে বসন্ত ফুলবনে :এ গানটি দিন ১৩৩৩ সালের ২৮ অগ্রহায়ণে রচনা করেন । যা সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে চোখের এর অন্তর্ভুক্ত হয়। গানটি রেকর্ড করেছিলেন গানের পাখি নামে খ্যাত শিল্পী আব্বাস উদ্দিন।

স্নিগ্ধ শ্যাম বেণী বর্ণা :এ গানটি ১৩৪০ সালের জৈষ্ঠ্য মাসে রচনা করেন। মাসিক বুলবুলিতে প্রকাশ পায় এ গানটি। গানের মালা গ্রন্থে প্রকাশিত হয় ও শিল্পী আব্বাস উদ্দিন রেকর্ড করেন।

কারার ঐ লৌহ কপাট গান : ১৯২০ সালে রচনা করেন । ১৯২০ সালের জানুয়ারিতে পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের ফলে তখন হুগলি কলকাতা ও আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করে জেলে আটকে রাখেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বাংলার কথা পত্রিকায় একটি চিঠি পাঠালে কবি এ অপূর্ব সুরে গানটি রচনা করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একটি মুজিব নগর বেতার থেকে প্রতিদিনই প্রচার হত। ফলে আমাদের দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা পেয়েছ্ ে।

যার হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই : এ গানটি ১৯৩৮ সালে রচনা করেন । সন্তোষ সেনগুপ্ত এবং বুলবুল দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয়। সম্ভবত নজরুলের দাম্পত্য জীবন সংঘটিত না হওয়া নার্গিসের দ্বিতীয় বিয়ের আগে নজরুলকে একটি চিঠি দিলে সেটি হাতে পাওয়ার সময় বন্ধু শৈলাজানন্দকে চিঠিটি খুলে পড়তে বলেন। তিনি চিঠিটি পড়ে বলেন এবং তার উত্তর দিতে বললেন। উত্তর দিলেন এ গানের মাধ্যমে।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আছে শান্ত হয়ে : এ গানটি ১৯৩০ সালের ৭ মে দ্বিতীয় পত্র অরিন্দম বুলবুল চার বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন । এতে কাবর হৃদয়ে ভীষণ ব্যাথা পান। এ গানটি ১৩৪৪ সালে বুলবুল পত্রিকায় প্রকাশিত এ গানটি

নদীর নাম সই অঞ্জনা : হঠাৎ একদিন নজরুলের সামনে শিল্পী আব্বাস উদ্দিন নদীর নাম সই কচুয়া, ভাওয়াইয়া গানটি গান। নজরুল তাকে আবার গানটি গাইতে বললেন। এভাবে নদীর নাম সই অঞ্জনা গানটি রচনা করেন যা স্থান পায় এবং আব্বাস উদ্দিনের কন্ঠে রেকর্ড করা হয়্।

চল চল চল : গানটি কবি নজরুল ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে রচনা করেন। গানটির গীতিকার কে ১৩৩৪-১৩৩৫ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত হিসাবে এ গানটি রচনা করেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ও বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়ে এ গানটি আমাদের সেনাবাহিনীর মার্চিং সংগীত হিসেবে গ্রহণ করে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো জন্যেই তিনি ্এ উদ্যোগ নেন।

মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী : এটি একটি জনপ্রিয় গান। বঙ্গবাণী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। নজরুলগীতি বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত গানটি রচনা করেন।

শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল : হুগলী জেলে ১ বছরের কারাদণ্ড খোগকরার সময়ে তিনি এ গানটি লিখেন ্। ১৩৩১ সালের সকল অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ গানটি রচনা করেন জেলে বসে।

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে :এ ভক্তিমূলক গানটি শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের বিশেষ অনুরোধে তিনি এ গানটি রচনা করেন। এটি নজরুলের গান হিসেবে বর্তমানে পরিচিত্। জুলফিকার গ্রন্থে এ গানটি স্থান পেয়েছে। কবি তার প্রিয় শিক্ষার্থী ইন্দুবালা গান শেখাতে ছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তেই শিল্পী আব্বাস উদ্দিন একটি ইসলামিক সংগীত লেখার প্রস্তাব দেন। কবি ইন্দুবালকে বাড়ি যেতে বলার পর অর্থ ঘণ্টার মধ্যে ঘরের দরজা বন্ধ করে ঐতিহাসিক ইসলামিক এ সংগীতটি রমজান শেষে ঈদেও আগমনী বার্তা বহনকারী এ গানটি রচনা করেন।

আমরা শক্তি আমরা বল:গানটি ১৯২৬ সালে কবি রচনা করেন । ১৯২৬ সালের বার্ষিক সম্মেলনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তিনি এ গানটি রচনা করেন।

ইসলামের সওদালয় : এ গানটি কবি ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে গানটি রচনা করার পরের দিনই এটি রচনা করেন। এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অতীতে ১৩৩৮ সালে এটি প্রকাশিত হয় আব্বাস উদ্দিনের কন্ঠে এটি পরবর্তী সময়ে রেকর্ড করা হয়।

জাগো অনশন বন্দী : ফরাসি ভাষায় অনূদিত ছিল পরে তিনি তরজমা করে বাংলায় আনেন রচনাকালে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে পহেলা বৈশাখ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালের এপ্রিল মাসে গণবাণী পত্রিকা প্রকাশিত হয়

জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা : ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে নামে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হয় আনন্দমঠ এর উদ্বোধনী সংগীত হিসাবে তিনি নিজেই এ গানটি পরিবেশন করেন। বাংলা ভাষার জগতে আগমন করে নিয়েছেন থাকবে ।


কাজীনজরুলছিলেনবহুমুখীপ্রতিভাধরকবি
কবি কাজী নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। সারাজীবন তিনি অনেক খ্যাতি অর্জন করেন। আর এ খ্যাতির পিছনে রয়েছে তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ও সৃষ্টিশীল সাত্যি কর্ম। একজন কবি এতগুলো কবিতা, গল্প, নাটক,গ্রন্থ, গজল, ইসলামী গান ও সংবাদপত্র সম্পাদনা করেন তা সত্যিই বিস্ময়কর প্রতিধর এ কবিকে আমরা একজন কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রবন্ধকার,শিশু সাহিত্যিক, ছোট গল্পকার,লেখক, অভিনেতা, গীতিকার, সুরকার, সাংবাদিক, সম্পাদক, হামদ নাত লেখক, বাংলাবাদক,‘লাঙ্গল’ পত্রিকায় তিনি সাম্যবাদী, বিপ্লবী কবিতা প্রকাশ পায় এবং এখানে তিনি বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। ইংরেজদের রোষানল এড়ানোর জন্যে।খোলা মনের প্রেমিক হিসেবে চিনত।

ব্রিটিশ বিরোধী কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন ছদ্ম নামত ব্যবহার করেন। এ গুলো হলো- কহলন, সারমি, শ্যামসুন্দর, বুলবুল, পাইয়োনিয়ার ও ধূমকেতু। প্রতি বছর তাঁর রচিত রমজানের ঈদের যে সঙ্গীতটি বাজানো হয়Ñ তা মুসলিম জাহানের প্রত্যেক নর-নারীকে উদ্বেলিত করে থাকে। অগ্নিবীণার বিদ্রোহীর সুর উদ্ভাসিত হয়েছে। বিদ্রোহী কবিতা থেকেই তিনি বিদ্রোহী কবি খ্যাতি অর্জন করেন। এটি একটি অনবদ্ধ সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্ম- যা এক রাতে তিনি লিখেছেন। নজরুলের রনসঙ্গীত এখন স্বাধীন সার্বভৌমিক রাষ্ট্রে বা রণসঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃত।

১৯৩২ সালে কবি তাঁর বিখ্যাত কান্ডারীর হুশিয়ার, গান গেয়ে শোন করে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩০ বছর। সে সময় তাঁকে বাঙালি জাতির পক্ষে থেকে জাতীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।

নজরুলের অজস্র সুন্দর শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা বা কবিতাগুলো উদ্দীপনমূলক কবিতা, দেশকে ও দেশের মানুষকে, কৃষক, কুলি,মজুর , জেলে সবাইকে ভালোবাসার কবিতা, স্বাধীনতার জন্যে কবিতা, বড় হওয়ার রোমাঞ্চকর স্বপ্ন, অভিযানের কবিতা নানা ধর্মের মানুষের জন্য প্রীতি ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কবিতা, ধর্ম ও ঐতিহ্য বিষয়ক কবিতা তিনি লিখেছেন।

সমগ্র জীবনে বাংলা সাহিত্যের একজন কবি তিনি। সজনীকান্ড দাস নামক জনৈক ব্যাক্তি ছাড়া কেউ নজরুলকে কটাক্ষ করেছেনÑ এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

তিনি ছিলেন মানবতার কবি,সাম্যের কবি, তারুণ্যের ও উদ্দীপনার কবি। ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী ও সৈনিক হিসেবে দৈহিকভাবে সুঠাম ও দক্ষ ছিলেন। তাঁকে কেউ ডাকতেন কাজী দা,কবিদা কেউ নুরু, কেউ নজরুল। তিনিই নজরুল ইসলাম। আমাদের হৃদয়ের কবি সাহিত্যের কবি। জাতীয় কবি ও সর্বোপরি তিনি ছিলেন বিদ্রোহী কবি। এত প্রতিভা সম্পন্ন বাংলা সাহিত্যের আর দ্বিতীয় কেউ আছে কি-না তা জানা হয়নি আজও।

তথ্যসূত্র : মো.হাবিবুর রহমান রচিত‘ছোটদের নজরুল, নবারুণ, বাংলাদেশ সচিত্র মাসিক পত্রিকা ,শেখ মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম রচিত-‘নজরুল জীবনের ট্য্রাজেডি’,ডা.আনিস আহমেদের সম্পাদনায়‘ কাজী নজরুলের জীবনী’, বেদার উদ্দিন আহমেদ রচিত নজরুল সঙ্গীত প্রসঙ্গ গ্রন্থ থেকে এবং ওয়েবসাইড থেকে সংগৃহীত ছবি

ছবি পরিচালনার সঙ্গে অভিনয়ে ও নজরুল, তাঁকে একবার বিপদ থেকে বাঁচান রবীন্দ্রনাথ

তিনি বিদ্রোহী কবি ৷ তিনি টর্পেডো ৷ তিনি মহাপ্রলয়ের নটরাজ ৷ এই অভিধাগুলোর আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার অনেক দিক ৷ জীবনের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেওয়া ব্যক্তিগত শোক যেমন অনুচ্চরিত থাকে দুখু মিঞার জীবনচর্চায়, ঠিক তেমনই অনালোচিত থেকে যায় সিনেমার পর্দায় কাজী নজরুল ইসলামের কাজ ৷

সংখ্যায় মাত্র একটি হলেও নজরুল বাংলা ছবি পরিচালনা করেছিলেন ৷ সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি তাঁকে দেখা গিয়েছিল অভিনয়েও ৷ তিনের দশকে ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল নজরুলের ৷ প্রতি মাসে তাঁর পারিশ্রমিক ছিল ৫০০ টাকা ৷ ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি মুক্তি পেয়েছিল নজরুল পরিচালিত একমাত্র ছবি ‘ধ্রুব’ ৷ নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা ‘ভক্ত ধ্রুব’ অনুসারে তৈরি এই ছবিতে সহ-পরিচালক ছিলেন নজরুল ৷ আর একজন পরিচালক ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দে৷

নজরুলের সঙ্গীত পরিচালনায় সেকালে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল ‘ধ্রুব’-র গানগুলি ৷ ছবিতে ব্যবহৃত ১৮ টি গানের মধ্যে ১৭ টিরই সুর দিয়েছিলেন তিনি ৷ চারটে গানে প্লেব্যাকও করেছিলেন ৷ পাশাপাশি, ফিল্ম কোম্পানির কথায় ছবিতে নারদের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন অগ্নিবীণার স্রষ্টা ৷ বাকি কুশীলবদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী, আঙুরবালা, পারুলবালা, নিত্যানন্দ ঘটক, কুঞ্জলাল চক্রবর্তী, কার্তিক দে এবং যুগ্ম পরিচালক সত্যেন্দ্রনাথ দে ৷ তবে এই ছবির পর সেই ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন নজরুল ৷ শোনা যায়, পারিশ্রমিক নিয়ে দু পক্ষের মতান্তরই এর কারণ ৷

এর পরেও রুপোলি দুনিয়ার সঙ্গে কিন্তু সম্পর্ক অটুট ছিল তাঁর ৷ ১৯৩৭ সালে মুক্তি পায় ‘বিদ্যাপতি’ ৷ দেবকী বসুর সঙ্গে এই ছবির গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছিলেন নজরুল ৷ পাহাড়ি স্যান্যাল, কানন দেবী, ছায়া দেবী অভিনীত ‘বিদ্যাপতি’ জনপ্রিয়তার নিরিখে ছিল সফল ছবি ৷ পরের বছর ১৯৩৮-এ পরিচালক নরেশ মিত্র ঠিক করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ‘গোরা’ নিয়ে ছবি করবেন ৷ সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন কাজী নজরুল ইসলাম ৷

রবি ঠাকুরের উপন্যাস থেকে হওয়া ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করছেন কাজী নজরুল ৷ এই মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হয়েছিল পরাধীন বাংলার সাংস্কৃতিক আবহ ৷ বিশ্বভারতীর থেকে অনুমতি না নিয়েই গান রেকর্ড করালেন নজরুল ৷ ভেবেছিলেন, দায়িত্বে যখন তিনি, প্রতিষ্ঠান কোনও আপত্তি করবে না ৷ কিন্তু তাঁর বিশ্বাস টাল খেয়ে গিয়েছিল ছবি মুক্তির দুদিন আগে ৷ বিশ্বভারতীর তরফে আপত্তি তোলা হল গনের বিশুদ্ধতা নিয়ে ৷ তাদের বক্তব্য ছিল, নজরুলের পরিচালনায় রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ডিংয়ে ত্রুটি আছে ৷ ফলে, তারা অনুমতি দিতে পারবে না ৷ এদিকে প্রযোজকের মাথায় হাত!

‘ধ্রুব’ ছবির পুস্তিকা, উত্তরপাড়া জীবনস্মৃতি ডিজিটাল আর্কাইভের সৌজন্যে প্রাপ্ত

মরিয়া নজরুল ঠিক করলেন হাল ছাড়লে হবে না ৷ একবার শেষ চেষ্টা করতেই হবে ৷ তিনি জানতেন কে তাঁকে রক্ষা করতে পারেন ৷ ছবির কপি, প্রোজেকশনের যন্ত্র নিয়ে তিনি ছুটলেন শান্তিনিকেতন ৷ হাজির হলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে ৷ তাঁর অনুরোধ, কবি যেন একবার ছবিটি দেখেন, গানগুলি শোনেন, যদি মনে হয় ঠিক আছে, তিনি যেন তাঁর লিখিত অনুমতি দেন ৷ ছবি মুক্তি না পেলে প্রযোজকের অনেক টাকা ক্ষতি হয়ে যাবে ৷ ছবিটি দেখার জন্য অপেক্ষা করেননি রবীন্দ্রনাথ ৷ নজরুলের কথাতেই তিনি তাঁর লিখিত অনুমতি দিয়ে দিয়েছিলেন ৷ নজরুলের উপর তাঁর পূর্ণ আস্থা ছিল৷

১৯৩৮-এর ৩০ জুলাই মুক্তি পেয়েছিল ‘গোরা’ ৷ নামভূমিকায় ছিলেন নরেশ মিত্র, প্রতিমা দাশগুপ্ত, জীবন গঙ্গোপাধ্যায়, সুহাসিনী দেবী এবং রাজলক্ষ্মী দেবী ৷

ছবির পাশাপাশি নজরুল কাজ করেছেন থিয়েটারে মঞ্চেও৷ ‘সিরাজউদদৌলা’, ‘জাহাঙ্গীর’, ‘অন্নপূর্ণা’ নাটকের জন্য তিনি গান লিখেছেন এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন ৷

কিন্তু তাঁর এই কাজগুলির রক্ষণাবেক্ষণ ঠিক ভাবে হয়নি ৷ ‘ধ্রব’-র দুর্লভ নেগেটিভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে